• ‘বরাভয়’ থাকলে চুনো পুঁটিরও কোনও ভয় নেই
    আনন্দবাজার | ০৮ জুলাই ২০২৫
  • ‘‘রাঘব বোয়ালের উপরে নজর রাখা সহজ। কিন্তু চুনো পুঁটি কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, ধরা কঠিন,’’ বলছেন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা। তবে সঙ্গে জুড়ছেন, ‘‘তা বলে তারা ধরে পড়ে না, এমন নয়। ধরার কায়দা আছে।’’ নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর (এনসিবি) পূর্বাঞ্চলের এক আধিকারিকের দাবি, ‘‘কোন এলাকায়, কারা মাদকাসক্ত— তাদের উপরে নজর রাখলেই জানা যায়, কোথা থেকে মাদক আসছে। তখন সেটা বড় চক্রের না স্থানীয় ভাবে তৈরি— তা খোঁজ করা শক্ত নয়।’’

    সূত্রের দাবি, প্রথম শ্রেণির হেরোইনের দাম কেজিতে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মাঠেঘাটে যে হেরোইন বিক্রি হয় তা ‘ক্রুড’ (অশোধিত)। মোটামুটি ১৫-২০ লক্ষ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এই ‘ক্রুড’-ই বাংলা বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয়। নদিয়ার বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দামে যে পুরিয়া মেলে তাতে সামান্য ‘ক্রুড’ থাকে। আসক্তদের দিনে চার-পাঁচটা পুরিয়া লাগে। সে পুরিয়া কোথা থেকে আসছে, তার উপরে নজর রাখলেই কেল্লা ফতে হওয়ার কথা।তার পরেও স্থানীয় মাদকের কারবার চলার রহস্য কী?

    সবই লুকিয়ে ‘ইনফর্মার’ (খবর দেওয়ার লোক) শব্দের অন্দরে। এনসিবি-র ‘ইনফর্মার’-দের কেউ আগে এই কারবারে সরাসরি জড়িত ছিল। কেউ এখনও আছে। মাদক কারবার সংক্রান্ত নির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার জন্য সরকারের থেকে টাকা পায় তারা। তাদের থেকে কোনও সন্দেহভাজনের সন্ধান মিললে, তার গতিবিধি লক্ষ্য করে এনসিবি। মাদক তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান নিয়মিত বা বড় পরিমাণে সরবরাহ করা হচ্ছে খবর পেলে বাড়ে তৎপরতা। ধৃতদের সূত্রেও জানা যায়, নতুন কারবারিদের নাম।

    তবে অনেক সময়ে যার বা যাদের উপরে এনসিবি নজর রেখেছে, তারা নজরদারির খবর নিজস্ব ‘ইনফর্মার’ সূত্রে পেয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছে। সে কারণে কারবার বন্ধ করা বা কারবারিকে ধরার আগে, বিশদ তথ্য মুখবন্ধ খামে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয় এনসিবির আধিকারিকদের। অভিযানের সময় পুলিশের সাহায্য নেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে সব তথ্য পুলিশকে জানায় না এনসিবি। ঘটনাচক্রে, মালদহের ইংরেজবাজারে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন পুলিশের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর।

    ছোটখাট কারবারিরা মাদকের জাল তখনই ছড়ানোর সাহস পায়, যখন মাথার উপরে ‘বরাভয়’ থাকে। সম্প্রতি নদিয়ার ধুবুলিয়ায় গাড়ি আটকে সাড়ে চার কেজি হেরোইন-সহ ধৃত তিন জনের অন্যতম বড় নলদহের আব্দুল সালাম মণ্ডল, যার স্ত্রী পলাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন তৃণমূল সদস্য। তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আব্দুলের দহরম-মহরম। একই রকম অভিযোগ শোনা গিয়েছে মালদহের কালিয়াচকের মোজমপুর, নওদা-যদুপুরের মাদক কারবারে জড়িতদের সম্পর্কেও। তবে ওয়াকিবহালদের দাবি, প্রয়োজন ফুরোলে, মাদকের কোনও ছোট কারবারির মাথার উপরের হাত সরে গিয়ে তার প্রতিযোগীর মাথায় যায়। যার মাথার উপরের হাত সরে, তার খবর চলে যায় পুলিশ-এনসিবির কাছে।তৃণমূলের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা চেয়ারম্যান রুকবানুর রহমান অবশ্য বলেন, “যদি দু’-এক জন কখনও, কোথাও এ সবের সঙ্গে জড়ায়, দল তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করেছে।”

    এক এনসিবি কর্তার কথায়, ‘‘মাদকের কারবারে যখন কেউ কারও ব্যবসায় ক্ষতি করতে চায় বা জেলে ঢুকিয়ে দিতে চায়, তখন তারা আমাদের খবর দেয়।” জলপাইগুড়ির এক পুলিশ কর্তা বলেন, “মাদক কারবারের ছোট সিন্ডিকেটে লাইনম্যান বা মিডলম্যানদের সংখ্যা বেশি থাকে না। সেকেন্ড লাইনে আসা খবরে ভরসা রাখতে হয়।” কী সেই ‘সেকেন্ড লাইন’? পুলিশকর্তা হেসে বলেন, “জন-সচেতনতা।” জলপাইগুড়ির মাদকের কারবারি রাজা যাকে বলেছিল, “বেইমানি।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)