• নেই ইউনিয়ন, তবু তৃণমূলের ‘ছাত্রনেতাদের’ রাজ্যপাট বহাল
    আনন্দবাজার | ০৮ জুলাই ২০২৫
  • মাত্র মাস কয়েক আগে স্নাতকোত্তর স্তরের জেনারেল ইলেক্টিভ (জিই) পরীক্ষা চলার সময়ে ‘গানবাজনা’ জমে উঠেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুরের শিক্ষাঙ্গনে। পরীক্ষা তো হলটা কী! ‘বসন্ত উৎসব’ উদ্‌যাপন বন্ধ থাকতে পারে না। অভিযোগ, ছাত্র সংসদ না থাকলেও শাসক দলের অনুগত ‘প্রভাবশালী’ ছাত্র সংগঠনের প্রশ্রয়ে মাইক বাজিয়ে বসন্ত উৎসবের হুল্লোড় বন্ধ করা যায়নি শেষ পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের অনেকেরই অভিযোগ, প্রবল শব্দদূষণের মধ্যেই সে দিন বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া পরীক্ষা দিতে বাধ‍্য হন।

    ছাত্র সংসদের ভোটহীন শিক্ষাঙ্গনে ইউনিয়ন রুম বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। খাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্বর্তী উপাচার্য শান্তা দত্ত দে তার আগে থেকেও ছাত্র নেতাদের একাংশকে ‘লুম্পেনরাজ’ বলে চিহ্নিত করে ইউনিয়ন রুমগুলি বন্ধ করানোয় উদ‍্যোগী হন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে-কানাচে ইউনিয়ন রুম বন্ধ হলেও রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রনেতাদের মৌরসিপাট্টা খর্ব হয়নি। তার প্রমাণ আলিপুর ক‍্যাম্পাসের বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন নিয়েও পদক্ষেপ করতে পারেননি কর্তৃপক্ষ। বরং দিন পনেরো আগেও দেখা গিয়েছে, আলিপুরেই ‘ডিসকলেজিয়েট’ হওয়া বেশ কয়েক জন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসানোর দাবিতে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন আসরে নেমেছে। ঘেরাও হয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা। অভিযোগ, খাতায়-কলমে কোনও ছাত্র প্রতিনিধি না থাকলেও এই সমস‍্যা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্বর্তী উপাচার্যের বৈঠকের সময়ে কলেজ স্ট্রিটে তৎপর ছিলেন আলিপুরের এক ‘গবেষক-নেতা’।

    ইউনিয়ন রুম না থাকলেও বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে এমন বেতাজ বাদশার অভাব নেই। কেউ বিরোধীদের পোস্টার ছেঁড়ার নির্দেশ দিচ্ছেন বলে সিসি ক‍্যামেরায় ধরা পড়ছে। কেউ পরীক্ষা চলাকালীন কী ভাবে সব সামলাতে হবে, পরীক্ষার হলে ঢুকে শিক্ষকদের তা শিখিয়ে যাচ্ছেন। আলিপুর ক‍্যাম্পাসের এক অধ‍্যাপক বলেন, “বিভিন্ন বিভাগে প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের নাক গলানো এখন স্বাভাবিক নিয়ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষাঙ্গন কিছুটা নির্জনে। সন্ধ‍্যা পর্যন্ত ক্লাস চলে। আইন কলেজের ঘটনার পরে সত‍্যিই ভয় করে। ছাত্রছাত্রীদের উপরেও তো ছাত্র-কাম-নেতাদের জুলুম কম নয়!”

    ছাত্র রাজনীতি এ রাজ‍্যে বা দেশে বহু যুগই মূল স্রোতের রাজনীতিতে ঢোকার পাদানি। কিন্তু মনোজিৎ মিশ্রের কীর্তির পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এ রাজ‍্যে কলেজে কলেজে কারা আজকাল ছাত্র রাজনীতির মুখ! তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতৃত্ব কসবার আইন কলেজের ঘটনার পরে রাতারাতি মনোজিতের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। কলেজে গণধর্ষণের মূল অভিযুক্ত মনোজিতের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দক্ষিণ কলকাতার জেলা তৃণমূল যুব নেতা সার্থক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি হওয়ার সুবাদে অনেকের সঙ্গে পরিচয় আমার থাকতেই পারে। ধর্ষকের একটাই পরিচয়, সে ধর্ষক। মনোজিৎকে কোনও দলের বলাটা বোকামি। আমি ওর কঠোর শাস্তি চাই।’’ দীর্ঘদিন তৃণমূলের হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে লিপ্ত সার্থক আশুতোষ কলেজের ‘হেড ক্লার্ক’। আশুতোষেরই প্রাক্তনী তিনি। সেই সঙ্গে কলকাতার আরও কয়েকটি কলেজের পরিচালন সমিতিতেও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি সদস্য। কোন যোগ্যতায় একাধিক কলেজের সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েছেন তিনি? বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন রয়েছে।

    নানা অপকর্মের অভিযোগ ওঠার পরেও তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনে লেগে থেকে সংগঠনের বা দলের উঁচু পদে ‘সম্মানিত’ হওয়ার নমুনাও নেহাত কম নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক প্রবীণ শিক্ষককে নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে পিএইচডি-রত ছাত্র গৌরব দত্ত মুস্তাফির নামে। তাঁকে দু’বছর সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করেছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গৌরবের প্রভাব খর্ব হয়নি। মাস কয়েক আগে সায়েন্স কলেজের ইউনিয়ন রুমে বিরোধীদের আটকে রাখা, ভিতরে মদ্যপান, এক ছাত্রীকে কটূক্তির মতো নানা অভিযোগ ওঠার সময়ে গৌরবের নাম জড়িয়েছিল। গৌরব এখনও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কার্যকরী সদস্য। তৃণমূলের উত্তর কলকাতারও যুব নেতা। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভিডিআর ল্যাবরেটরিতে কর্মরত। তাঁর পিএইচডি অবশ্য শেষ হয়নি। বরং নথিভুক্তি নিয়ে কিছুটা আইনি জট রয়েছে। গৌরব বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষীদের লকডাউনে সহায়তা, আমপানে পড়া গাছ পরিষ্কার থেকে ক্যাম্পাসে নানা ভাল কাজে যুক্ত। এটা সবাই জানে।’’

    তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, ‘‘সব অপরাধ এক নয়। অপরাধ অনুযায়ীই শাস্তির মাত্রা ঠিক হয়। অনেকেই শাস্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ শাস্তির মেয়াদ শেষে আবার ফিরে আসেন।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)