জানোয়ারেরা এ সব করে না কুণালবাবু, এমন কাজ শুধু মানুষই করে! ধর্ষণকাণ্ডে ভুল উপমায় আপত্তি প্রাণীবিদদের
আনন্দবাজার | ২৭ জুন ২০২৫
কসবার আইন কলেজের ঘটনা ব্যতিক্রমী নয়। ব্যতিক্রমী নয়, রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের প্রতিক্রিয়াও। বহু যুগ ধরেই ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের দায় নির্দ্বিধায় জানোয়ার-জগতের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভারতীয় সংস্কৃতিতে মজ্জাগত। মজ্জাগত, ‘পাশবিক’ বা ‘জান্তব’ তকমায় দেগে দেওয়া। অথচ প্রাণীবিদদের মত এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই ভিন্ন।
কসবার আইন কলেজে ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে শুক্রবার সকালে সমাজমাধ্যমে কুণাল লিখেছিলেন, ‘‘এ সব জানোয়ারকে মেরে পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেওয়া উচিত।’’ বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকেও একাধিক বার ওই শব্দ ব্যবহার করে ধর্ষণকে ‘মনুষ্যেতর প্রবৃত্তি’ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তিনি। যেমনটা শোনা গিয়েছিল আরজি আন্দোলনের প্রতিবাদীদের একাংশের মুখেও। ধর্ষকের মানসিকতা বোঝাতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘পাশবিক’, ‘জান্তব’-এর মতো শব্দবন্ধ। আরজি কর-ও প্রথম নয়। বহু কাল ধরেই এমন অনেক 'মানবিক' কর্মের উপমায় 'জান্তব' তুলনা আকছার হয়ে চলেছে। এটা কি ঠিক? সঙ্গত? বিজ্ঞানসঙ্গত?
ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ (জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা জ়েডএসআই)-এর ডেপুটি ডিরেক্টর কৌশিক দেউটির মতে ধর্ষণকে কোনও অবস্থাতেই ‘পশুসুলভ আচরণ’ বলা যায় না। তিনি বলেন, ‘‘মাংসাশী সিংহ থেকে তৃণভোজী হরিণ পর্যন্ত অনেক বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রেই নারীর ‘দখল’ নিয়ে পুরুষদের মধ্যে মরণপণ লড়াই ঘটে। বিজয়ী পুরুষ অধিকার করে নারীকে। কিন্তু পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নারীকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে যৌনসংসর্গের প্রক্রিয়া তেমন দেখা যায় না।’’
প্রাণী-আচরণবিদ্যা (ইথোলজি) বিশারদ, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষিকা সুচিত্রা ঘোষের মতে, ‘‘ধর্ষণ আদতে মনুষ্যসমাজের একাংশেরই মৌলিক প্রবৃত্তি। সম্ভবত, বিষয়টিকে জাস্টিফাই করার জন্যই আমরা ‘পাশবিক’, ‘জান্তব’ মতে শব্দের আড়াল খুঁজি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পশুরা যৌনসংসর্গের জন্য মানুষের মতো আড়াল খোঁজে না। সেটাই তাদের প্রকৃতিদত্ত প্রবৃত্তি। কিন্তু মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিবর্তনে মানুষের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও পশুসমাজের ধর্ষণের তেমন উদাহরণ মেলে না। জিনগত ভাবে এই অপরাধ প্রবণতা মানুষের মধ্যেই রয়েছে।’’
যদিও হাতি, ডলফিনের মতো উচ্চশ্রেণির যুক্তিবুদ্ধি যথেষ্ট উন্নত বলে জানান তিনি। উন্নততর আর এক স্তন্যপায়ী বানর এবং বনমানুষদের মধ্যে অবশ্য জোর করে যৌনলিপ্সা মেটানোর সামান্য কিছু উদহরণ রয়েছে। যার সঙ্গে ধর্ষণের তুলনা টানা যেতে পারে। ঘটনাচক্রে, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুযায়ী বানরকুল মানুষেরই নিকটাত্মীয়। রাষ্ট্রপতি ‘নারীরত্ন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত বন্যপ্রাণ গবেষক তিয়াসা আঢ্য বলেন, ‘‘ভারতে রেসাস ম্যাকাক গোত্রের বানরের পুরুষদের মধ্যে জোর করে যৌনতার কয়েকটি নজির রয়েছে। তবে তা একেবারেই বিরল। তা ছাড়া, ধর্ষণের পরে নৃশংস অত্যাচারের যে ঘটনা মনুষ্যজগতে অহরহ ঘটে, পশুসমাজে তার নজির নেই। আর গণধর্ষণের উদারহণ মানুষ ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।’’
সুচিত্রা এবং তিয়াসার মতে, ভারতীয় এবং এমনকি, পশ্চিমি সংস্কৃতিতেও পশুকে মানুষের তুলনায় হীনতর দেখানোর শিক্ষা রয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। তাই মনুষ্যচরিত্রের উদাহরণ দিতে গিয়ে অক্লেশে ব্যবহার করা হয় ‘গাধা’, ‘শকুন’ উপমা। ধর্ষণের ক্ষেত্রে জানোয়ারের উদাহরণ টানাও সেই প্রবণতারই ধারা বেয়ে এসেছে। তিয়াসার কথায়, ‘‘ধর্ষণের ক্ষেত্রে ‘পাশবিক’ শব্দ ব্যবহারের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণই নেই। পশুরা মানুষের মতো ‘পাশবিক’ হতে পারে না। বড়জোর এমন অপরাধকে ‘অমানবিক’ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ, সাধারণ ভাবে ধর্ষণ সুস্থ ‘মানবিক প্রবণতা’ হতে পারে না।’’