• সর্বধর্ম সমন্বয়ের মহামিলন ক্ষেত্র – দিঘা জগন্নাথধাম
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৭ জুন ২০২৫
  • জবা সেন

    তিনি জগতের নাথ, সকলের প্রভু ‘জগন্নাথ’। মনে ভক্তি থাকলে যে কোনও ধর্মের মানুষ তাঁকে দর্শন করতে পারেন। তাই দিঘার ‘জগন্নাথধাম’-এ সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার। এবারথেকে দিঘা শুধুমাত্র ছুটি কাটানোর জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে না। নতুন জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনের পর থেকে বদলে গিয়েছে সৈকতনগরীর পরিচিতি। দিঘায় ঘুরতে এসে এবারথেকে সকল পর্যটকদের আইটেনারির মধ্যে থাকতেই হবে জগন্নাথ মন্দিরের নাম। পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যাওয়ার এক আদর্শ ঠিকানা হয়ে উঠেছে দিঘা।

    সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই! কবি চণ্ডীদাসের এই উক্তিটির মাহাত্ম্য আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু বাস্তবে আমরা তা কতটা মেনে চলি সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। দেশজুড়েভেদাভেদ, হানাহানির ঘটনার মধ্যে যেন মিলন ও সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা দিচ্ছে দিঘার নবগঠিত জগন্নাথ মন্দির। সরকারের প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যায়ে দিঘায় প্রায় ২০ একর জমির উপরতৈরি হয়েছে এই মন্দির। সরকারি অর্থে যেহেতু কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়া যায় না সেই কারণে এর নাম দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। সরকারের তরফে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বতুলে দেওয়া হয়েছে ইস্কন কর্তৃপক্ষের হাতে। ইস্কন সাধারণত গৌরীয় বৈষ্ণব মতে পরিচালিত হয়। বিশ্বের যে কোনও ইস্কনের মন্দিরে সমস্ত ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষের প্রবেশাধিকাররয়েছে। গৌরীয় বৈষ্ণব মতে, মনে ভক্তি থাকলে যে কোনও ধর্মের মানুষই ঈশ্বরের দর্শন পেতে পারেন।

    দিঘার জগন্নাথ মন্দির পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। সেই ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য রাধারমণ দাস জানিয়েছেন, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে হিন্দু ছাড়াও যে কোনও ধর্মের মানুষ প্রবেশ করতে পারবেন। কারও প্রবেশে কোনও বাধা নেই।

    মূলত পুরীর জগন্নাথধামের আদলে সম্পূরা ঘরানায় দিঘার জগন্নাথ মন্দির তৈরি করা হয়েছে। পুজোর বেশিরভাগ নিয়মই পুরীর মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী পালন করা হয়। কিন্তু পুরীর মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। দিঘার মন্দিরে সেই নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দিরের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে সর্বসাধারণের জন্য তা খুলে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১ পর্যন্ত এবং দুপুর ৩টে থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। এই সময়ে সকলেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ দর্শন করতে পারেন।

    কীভাবে পৌঁছবেন মন্দিরে? নন্দকুমার-দিঘা ১১৬ বি জাতীয় সড়কে দিঘা গেটের কাছে নেমে হেঁটে মন্দিরে পৌঁছতে পারবেন। বাইপাস রাস্তা ধরেও যাওয়া যাবে জগন্নাথ মন্দিরে। রেলপথেযেতে চাইলে দিঘা স্টেশনে নেমে ৫০ মিটার হেঁটে মন্দিরে যেতে হবে।

    এই মন্দিরটি নির্মাণকাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হিডকোকে। রাজস্থানের গোলাপি বেলেপাথর দিয়ে তৈরি এই মন্দিরটি অপরূপ সুন্দর। ৩ বছর ধরে রাজস্থানের ৮০০ জন কারিগর এই মন্দির তৈরির কাজ করেছেন। পাশাপাশি মন্দির তৈরির পিছনে ইঞ্জিনিয়ারদেরও অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। মূল মন্দিরের উচ্চতা ২১৩ ফিট অর্থাৎ ৬৫ মিটার। মন্দিরে রয়েছে কলিঙ্গস্থাপত্যের ছোঁয়া। মন্দিরের মেঝেতে যে মার্বেল বসানো হয়েছে সেগুলি ভিয়েতনাম থেকে আনানো। মন্দির চত্বরে প্রায় ৫০০-র বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি মন্দিরের শীর্ষেভগবান বিষ্ণুর অষ্টধাতুর নীল চক্র স্থাপন করা হয়েছে।

    পুরীর মন্দিরের মতো দিঘাতেও প্রতিদিন নিয়ম মেনে ধ্বজা পরিবর্তন করা হয়। সেই কাজের জন্য পুরী থেকে ৩ জন ধ্বজাউত্তোলককে আনা হয়েছে। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটের সময় মন্দিরের চূড়ায় উত্তোলন করা হয় ধ্বজা। রীতি মেনে মন্দিরে নির্মাণ করা হয়েছে অশ্বদ্বার, ব্যাঘ্রদ্বার, হস্তিদ্বার ও সিংহদ্বার।পৌরাণিক রীতি মেনে কালো রঙের পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ১৮ মুখী অরুণ স্তম্ভ। স্তম্ভটি ৩৪ ফুট লম্বা। তার মাথায় রয়েছে অরুণা মূর্তি। অরুণ স্তম্ভের সামনের সিংহদ্বার দিয়েঢুকলেই পতিতপাবনের দর্শন পাবেন পুণ্যার্থীরা। পূর্ব দিকের এই সিংহদ্বারই মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার। এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে ব্যাঘ্রদ্বার। উত্তরে রয়েছে হস্তিদ্বার ও দক্ষিণে অশ্বদ্বার। জগন্নাথদেবের ভোগ রান্নার জন্য রয়েছে আলাদা ভোগশালা।

    প্রতিদিন ভগবানের ভোগ তৈরির দায়িত্বে থাকবে ইস্কন। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়দুইপাশে জলাশয়ে প্রচুর পদ্ম ফুটে থাকতে দেখা যায়। সামনের সিঁড়িতে বসে বিশ্রাম করতে পারবেন দর্শনার্থীরা।

    মূল মন্দিরে চারটি অংশ আছে। ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন ও গর্ভগৃহ। ভোগমণ্ডপে রয়েছে চারটি দরজা। অপরদিকে ১৬টি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে কালো পাথরের দশাবতার মূর্তি রয়েছে। ভোগমণ্ডপ ও নাটমন্দিরের মাঝে রয়েছে গরুড় স্তম্ভ। চারটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জগমোহন। জগমোহনের পরে রয়েছে মূল মন্দির বাগর্ভগৃহ। এই গর্ভগৃহেই রয়েছেন পাথর ও নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি। নিত্যদিন নিমকাঠের তৈরি মূর্তিতে পুজো করা হয়। পুরীর মতো দিঘার মন্দিরেও লক্ষ্মী মন্দিররয়েছে।

    স্নানযাত্রার পরে ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল দিঘার মন্দিরের গর্ভগৃহ। প্রায় ১৫ দিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন জগন্নাথ ও তাঁর দুই ভাইবোন। কারণ কথিত আছে, স্নানের পর প্রবল জ্বরআসে জগন্নাথের। সেই সময় ভক্তদের দর্শন দেন না তিনি। বৃহস্পতিবার ফের খোলা হয় গর্ভগৃহের দরজা। এ দিন নবযৌবন ও নেত্র উৎসব পালিত হয়।

    আজ রথযাত্রা। এই বছরই প্রথমবার দিঘার নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রার সূচনা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উপলক্ষ্যে বুধবারই দিঘায় পৌঁছেছেন তিনি।রথযাত্রার আগে গোটা সৈকতনগরীকে মুড়ে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তার চাদরে। প্রশাসনের তৎপরতা তুঙ্গে। রাধারমণ দাস জানিয়েছেন, রথযাত্রা উপলক্ষ্যে এ বার দিঘায় লক্ষ লক্ষ মানুষেরভিড় হবে। রথের প্রথম দিন অর্থাৎ শুক্রবার রথযাত্রার দিন প্রায় ২ লক্ষ মানুষ দিঘায় আসবেন। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রাশিয়া, চিন, ইউক্রেন থেকেও পূণ্যার্থীরা আসবেন দিঘায় । তিনিআরও জানিয়েছেন, ৩০ এপ্রিল উদ্বোধনের পর থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই দিঘার জগন্নাথ মন্দির দর্শন করেছেন।

    রথযাত্রার কয়েকদিন আগে থেকেই দিঘায় রথযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পুরীর মতোই দিঘার রথযাত্রায় আলাদা আলাদা তিনটি রথ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য তৈরি করা হয়েছে। জগন্নাথ দেবের রথের নাম নন্দীঘোষ। বলরামের রথের নাম তালধ্বজ ও সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন। তিনটি রথের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নন্দীঘোষে ১৬টি চাকা রয়েছে, এই রথ লালও হলুদ রঙের কাপড়ে ঢাকা থাকে। বলরামের তালধ্বজে ১৪টি চাকা রয়েছে, এটি লাল এবং নীল রঙের কাপড়ে ঢাকা থাকে। সুভদ্রার রথ দর্পদলনে ১২টি চাকা রয়েছে, এটি লাল ও কালোরঙের কাপড়ে ঢাকা থাকে। সেই সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, জগন্নাথ দেবের রথের সারথি হলেন দারুকা। রথ টানার দড়ির নাম শঙ্খচূড়া। ইতিমধ্যেই রথ তৈরির কাজ শেষহয়েছে। এ দিন এই রথে চেপেই ৮০০ মিটার রাস্তা অতিক্রম করে মাসির বাড়িতে যাবেন তিন ভাইবোন। দিঘার পুরোনো জগন্নাথ মন্দিরকে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করাহয়েছে। সেখানেই আগামী ৭দিন থাকবেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। উল্টোরথের দিন ফের ফিরে আসবেন মন্দিরে। শুক্রবার সোনার ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে রথযাত্রার সূচনাকরবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    পরিবারের বয়স্কদের পুরীতে জগন্নাথ দেবের দর্শন করাতে নিয়ে যেতে পারছেন না? তাঁদের নিয়ে যেতে পারেন দিঘার মন্দিরে। একেবারে পুরীর আদলে তৈরি এই মন্দিরে পুজো দেওয়াও খুবসহজ। মন্দির চত্বরে রয়েছে ডালা অর্কিড। সেখান থেকে ৫০ অথবা ১০০ টাকার ডালা কিনে পুজো দিতে পারবেন খুব সহজেই। ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেরাজ্যের বহু বাড়িতেই পৌঁছে গিয়েছে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে রাজ্যের সব বাড়িতেই প্রসাদ পৌঁছে যাবে। সেই প্রসাদ গ্রহণের পর ‘জগন্নাথধাম’ দর্শন করতে দিঘায় যাওয়ার ইচ্ছা হতে পারে সকল রাজ্যবাসীর।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)