রশিতে রাজনীতির টান! দিঘায় রথযাত্রার অভিভাবক স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা, শুভেন্দু দুই জেলার তিনটি কর্মসূচিতে
আনন্দবাজার | ২৬ জুন ২০২৫
ধর্মের রশিতে রাজনীতির স্পর্শ লেগে রয়েছে বহু কাল ধরেই। কিন্তু বাংলায় এ বার রথযাত্রার উৎসব প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে আলাদা গুরুত্বে হাজির। দুটো কারণে। এক: দিঘার নতুন জগন্নাথ মন্দির, তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া উন্মাদনা, কোথাও কোথাও বিতর্ক এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তার রথযাত্রার আয়োজন। দুই: আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা ভোট। সেই নির্বাচনে যখন হিন্দু ভোট তাদের পক্ষে একজোট করার চেষ্টা করছে বিজেপি, তখন তৃণমূলের লক্ষ্য নিজের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে অক্ষত রাখা এবং বাড়ানো। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্বর্ষের রথযাত্রায় সেই টানাটানির রাজনীতি স্পষ্ট। রামনবমীতে জেলায় জেলায় বিজেপি নেতাদের পাল্টা পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন তৃণমূল নেতারাও। কিন্তু এ বারের রথ নিয়ে টানাটানি খোদ মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতার মধ্যে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে রথের রশি দেখা যায় প্রতি বারই। শুভেন্দু অধিকারীরাও রথ টানেন প্রতি বার। কিন্তু এ বছর দিঘার জগন্নাথধামের উপস্থিতি, তাকে ঘিরে সাজ সাজ রব এবং তার রথের ভারে মমতার দিকে পাল্লা ঝুঁকে গিয়েছে অনেকটা বেশি। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে নিজের কর্মসূচি সাজাতে হয়েছে দিঘাকে মাথায় রেখে। শুক্রবার কলকাতা এবং পূর্ব মেদিনীপুর মিলিয়ে তিনটি রথযাত্রায় যোগ দেবেন শুভেন্দু।
রথযাত্রার দু’দিন আগে বুধবারই দিঘায় পৌঁছে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পৌঁছে গিয়েছেন রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী পুলক রায়, বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, অর্থ এবং স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী এবং দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু। যে সব বিষয় এই রথযাত্রার উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সেই সব দফতরের মন্ত্রীদের দিঘায় হাজির থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। রাস্তায় ধার জুড়ে বাঁশের ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে। নজর রাখতে হচ্ছে, যাতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিরবচ্ছিন্ন থাকে। সম্প্রতি কুম্ভমেলা এবং বেঙ্গালুরুতে আইপিএল জয় উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তেমন ঘটনা যাতে রথযাত্রা উপলক্ষে না ঘটে যায়, সে দিকে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে বিশেষ নজর দিতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের দিয়ে গোটা দিঘা শহর-সহ জগন্নাথ মন্দির এবং জগন্নাথের মাসির বাড়ি সাজানো হয়েছে। এককথায়, দিঘার রথযাত্রায় কোনও খামতি রাখতে নারাজ মমতা।
অক্ষয়তৃতীয়ার দিন দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, মন্দিরকে কেন্দ্র করে এ বছর রথযাত্রা আয়োজিত হবে। শাসক তৃণমূল দিঘার রথযাত্রাকে যে একটি ‘মেগাইভেন্টে’ পরিণত করতে চাইছে, সেটা স্পষ্ট। প্রতি বছর রথের দিন কলকাতায় ইসকনের রথযাত্রায় যোগ দিতেন মমতা। কিন্তু এ বছর দিঘার রথযাত্রা নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকায়, ৫ জুলাই উল্টোরথের দিন ইসকনের রথের রশিতে টান দেবেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর একটি মাত্র কর্মসূচি থাকলেও বিরোধী দলনেতার রয়েছে তিনটি কর্মসূচি। শুরু হবে উত্তর কলকাতা থেকে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে ‘সারা ভারত কীর্তন বাউল ও ভক্তিগীতি কল্যাণ ট্রাস্টে’র পক্ষ থেকে একটি রথযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে সেখানে রথের রশিতে টান দিয়ে নিজের কর্মসূচি শুরু করবেন শুভেন্দু। এর পর বিরোধী দলনেতার জোড়া কর্মসূচি রয়েছে তাঁর নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে। জেলার এক প্রান্তে মুখ্যমন্ত্রী যখন রথের রশিতে টান দেবেন, তখন জেলার অপর প্রান্তে রথযাত্রায় যোগ দেবেন শুভেন্দু।
বিরোধী দলনেতার দ্বিতীয় কর্মসূচি রয়েছে তমলুকে। সেখানে শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু মন্দির থেকে রথযাত্রা সূচনা করার পাশাপাশি পুরীধামের মহাপ্রসাদ বিলি করবেন শুভেন্দু। রাজ্য সরকার খাদ্য দফতরের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দুয়ারে দিঘার জগন্নাথধামের প্রসাদ পাঠাচ্ছে। তার পাল্টা তমলুকের রথের কর্মসূচিতে পুরীর মন্দিরের মহাপ্রসাদ বিলি করে শুভেন্দু জবাব দিতে চাইছেন বলে মনে করছে অভিজ্ঞমহল। এ প্রসঙ্গে ভগবানপুরের বিজেপি বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ মাইতি বলছেন, ‘‘জগন্নাথদেবের নাম করে রেশন দোকান মারফত প্রসাদ বিলি করে আমাদের মতো সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের ধর্মীয় ভাবে আঘাত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী দলনেতা মহাধাম পুরীর মহাপ্রসাদ বিলি করে সেই আঘাতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করবেন।’’ বিরোধী দলনেতার তৃতীয় তথা শেষ কর্মসূচি হবে সন্ধ্যায় মেচেদার শ্রীশ্রী শঙ্খানন্দ মন্দিরের রথযাত্রার কর্মসূচিতে।
দুই তরফের কর্মসূচিকে ঘিরে তরজাও চলছে। রামনগরের তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী অখিল গিরি বলছেন, ‘‘দিঘায় রথযাত্রার আয়োজন করে মুখ্যমন্ত্রী সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যোগদানের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। নিজের সেই ভাবনাকে ভিত্তি করেই রথযাত্রায় যোগ দিচ্ছেন তিনি, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। তাঁর এই উদ্যোগ বৃহত্তর স্বার্থে, এখানে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি নেই।’’ অপর দিকে কাঁথি দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক অরূপ দাস বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী দলনেতার রথযাত্রার কর্মসূচিতে যোগদানের একটি পার্থক্য রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর এ বছর হঠাৎ মনে হয়েছে, ঘটা করে সরকারি উদ্যোগে রথযাত্রা পালন করতে হবে। তাই তিনি দিঘায় এসে এত বড় আয়োজন করেছেন। আর বিরোধী দলনেতা রথযাত্রার যে সব কর্মসূচিতে যোগ দেবেন তা তিনি দীর্ঘ কাল ধরে করে আসছেন, নিজের সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। এ ক্ষেত্রে কোনও রাজনীতি নেই। আগামী দিনেও থাকবে না।’’
রথের পথ ধরে আপাতত এই সব তর্কবিতর্ক চলছে, চলবে। তবে সবারই মূল নজর এখন সামনের বছরের ভোটের দিকে। সদ্য হয়ে যাওয়া কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে বড় ব্যবধানে বিজেপি-কে হারিয়েছে তৃণমূল। তার আগে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি-কে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছিল তৃণমূল। আইনি জটিলতা কেটে গেলে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বসিরহাট লোকসভার উপনির্বাচন হতে পারে। আবার তেহট্টের তৃণমূল বিধায়ক তাপস সাহার মৃত্যুতে সেখানেও উপনির্বাচন হওয়ার কথা। এ সবের মধ্যেই বিধানসভা ভোটের হিসাবনিকাশ শুরু হয়ে গিয়েছে সব পক্ষেই। যেখানে ঠিক হবে, আরও পাঁচ বছরের জন্য রাজ্যের রশি কার হাতে থাকবে। কার হাতে? সেটা জানেন শুধু গণতন্ত্রের ‘অন্তর্যামী’-ই।