হাকিমপুর সীমান্তে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষার নামে হেনস্তার অভিযোগ
দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৪ জুন ২০২৫
বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসা– এই পালাবদলের জেরে উত্তর ২৪ পরগনার হাকিমপুর সীমান্তে বিএসএফ-এর কড়া প্রহরার নামে মানুষের নিত্যদিন হয়রানি বেড়েই চলেছে। অভিযোগ, স্থানীয় গ্রামবাসী থেকে শুরু করে শহর কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা স্কুল শিক্ষক ও সরকারি কর্মীদেরও। গ্রামের পুরুষদের পাশাপাশি ছাড় পাচ্ছেন না গ্রামের মেয়ে-বউ বা শিশুরাও। হেনস্তার শিকার হচ্ছেন স্বরূপনগর ব্লকের বিথারি-হাকিমপুর গ্রামপঞ্চায়েতের একাধিক গ্রামের বাসিন্দা এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনরাও। ফলে এই সীমান্ত সংলগ্ন তারালি, হাকিমপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ প্রতিদিন নাজেহাল হচ্ছেন।
সুরক্ষার নামে বিএসএফ-এর এই হেনস্তার জেরে অনেকে এই এলাকায় ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতেও ভয় পাচ্ছেন। এইসব গ্রামের প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষ বিয়ে দিতে চাইছেন না। ফলে তাঁরা দীর্ঘদিন অবিবাহিত থেকে যাচ্ছেন। অনেকের আবার বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলেও নতুন আত্মীয়দের হেনস্তার জেরে মাঝপথে সেই বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।
জানা গিয়েছে, হাকিমপুর সীমান্তের বহু পুরনো বাস স্ট্যান্ডে অবস্থিত বিএসএফ-এর সীমান্ত চৌকি থেকেই গ্রামবাসীরা এই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ। এই সীমান্ত চৌকিটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ থেকে প্রায় ৭৫০ মিটার দূরে। এই অঞ্চলের জিরো পয়েন্টে রয়েছে ‘সোনাই নদী’। সেই নদীর ওপারে বাংলাদেশের যশোর জেলার ভাদিয়ালী গ্রাম। মছলন্দপুর স্টেশন হয়ে তেঁতুলিয়া রোড হাকিমপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে মিশেছে। আর এই স্ট্যান্ড থেকে আরও দুটি রাস্তা সীমান্ত লাগোয়া ‘বিএসএফ রোড’ হয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে বেরিয়ে গিয়েছে। এর একটি হাকিমপুর বাজার হয়ে ‘সোনাই নদী’র পাশ দিয়ে তারালি গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করেছে। আর অন্যটি হাকিমপুর খাঁ পাড়া হয়ে এই গ্রামে প্রবেশ করেছে। রাস্তা দুটি গ্রামের জিরো পয়েন্ট লাগোয়া ‘সোনাই নদী’কে প্রায় একশো মিটার দূরত্বে রেখে গ্রামের ভিতরে শিরা-উপশিরার মতো প্রবাহিত হয়েছে। চেক পোস্ট পেরিয়েই রয়েছে হাকিমপুর হাইস্কুল এবং হাকিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। আরও একটু এগিয়ে গেলে সোনাই নদীর ধারে খাঁ বাড়ির একটি অংশে রয়েছে বহু পুরনো ‘ডাকঘর’।
এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিযোগ, প্রতিদিন তাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে এই চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় চেকিংয়ের নামে চরম হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সীমান্ত পাহারার নামে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চৌকিতে শরীর ও ব্যাগপত্র পরীক্ষার নামে বিএসএফ-এর বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানকার স্কুল থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। একইভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদেরও। প্রথমে তাদের ব্যাগপত্র চেক করা হচ্ছে। সন্দেহ হলে ভিতরে ডেকে নিয়ে জামা খুলেও চেক করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
অন্যদিকে হাকিমপুর বাজার ও তৎসংলগ্ন অধিকাংশ দোকানপাটগুলিতেও ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাধ্য হয়ে এখানকার স্থানীয় বেকার ছেলে-মেয়েদের তাই রুটিরুজির সন্ধানে অন্যত্র ছুটতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গায়ের জোরে হাকিমপুর বাস স্ট্যান্ডের এই চেকপোস্ট রাতারাতি অন্যের জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বলেও দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে। এই নিয়ে একাধিকবার বিএসএফ-এর উচ্চ পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে জমির দুই মালিক বৈঠক করেও কোনও লাভ হয়নি। তাঁরা বিতর্কের মুখে পড়ে জমি ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও কোনও দিনক্ষণ দিচ্ছেন না। কবে জমি ছেড়ে দেবেন, সেব্যাপারেও স্পষ্টভাবে কিছু বলছেন না। জমির এক মালিক স্থানীয় স্বরূপদহ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রউফ গায়েন ও হাকিমপুরের বাসিন্দা সোহরাব সরদারের জমিতে বেআইনিভাবে জোর করে ওই চেকপোস্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলাও দায়ের হয়েছে। চলতি জুন মাসেই সেই মামলার শুনানি রয়েছে।
বিএসএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ভিড় জমাচ্ছেন হাকিমপুর সীমান্তের বাসিন্দারা। সকাল থেকে দিনভর, এমনকি মধ্যরাতেও সেই অভিযোগের ঠেলায় ঘুম উড়েছে স্বরূপনগর থানার ওসি অরিন্দম হালদারের। ডিএম, এসডিও, বিডিও, এসপি এমনকী মানবাধিকার কমিশনের কাছেও অভিযোগ গিয়েছে। স্বরূপনগরের বিডিও বিষ্ণুপদ রায় বলেন, চেকিং নিয়ে গ্রামবাসীদের নিত্যদিনের অসন্তোষের অভিযোগ রয়েছে। সমাধান সূত্র খুঁজতে বিএসএফ আধিকারিকদের পাশাপাশি বিথারির ১০টি গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, উপপ্রধান এবং স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষজনকে নিয়ে বৈঠকে বসা হয়েছিল। সেখানে কিছু বিষয় উঠে আসে। তা নিয়ে একটা রেজোলিউশন আনা হয়েছে। এখন কতটা সমাধান হয়, তা দেখা যাক!