• ইতিহাস আঁকড়ে কংসাবতী তীরে দাঁড়িয়ে দেউলঘাটা
    এই সময় | ২৩ জুন ২০২৫
  • প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া

    কালের গর্ভে ইতিমধ্যে হারিয়ে গিয়েছে জেলার অমূল্য এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। আনুমানিক নবম-দশম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা কংসাবতী তীরের দেউলঘাটা মন্দিরের বাকি দেউলগুলি যাতে ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে টিকে থাকে, তার সংস্কারের কাজ শুরু করছে রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর।

    ২০০২ সালে এই মন্দিরক্ষেত্র সংস্কারের সময়ে ঘটেছিল দুর্ঘটনা। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গিয়েছে এই মন্দিরক্ষেত্রে টেরাকোটার তৈরি একটি স্থাপত্য। জেলার অন্যতম বিশিষ্ট মন্দির ও প্রত্নগবেষক সুভাষ রায় জানাচ্ছেন, কংসাবতী তীরের দেউলঘাটায় পাশাপাশি টেরাকোটার তিনটি মন্দির ছিল।

    অযত্নে মন্দিরগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ২০০২ সালে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বড় মন্দিরটির চারপাশের মাটি খুঁড়ে রেখেছিল। টানা বৃষ্টিতে মন্দিরের চারপাশ খোঁড়া জায়গায় জল জমে গিয়েছিল।

    সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ভোররাতে মন্দিরটি ধসে পড়ে। তা আজও নির্মাণ করা যায়নি। টোরাকোটা মন্দিরের ইটগুলি এখনও পড়ে রয়েছে। সুভাষের আক্ষেপ, ‘ইতিহাসের পাতা থেকে চিরকালের জন্য মুছে গিয়েছে এক অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।’

    দেউলঘাটায় আড়শার দিকে তিনটি ইটের দেউলের কথা প্রত্নগবেষকদের লেখাতেও উল্লেখ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন সুভাষ। তাঁর কথায়, ‘১৮৬৪–৬৫ সালে ইংরেজ লোকগবেষক ইটি ডালটনের ‘নোটস অন এ ট্যুর ইন মানভূম’ এবং ১৮৭২ বিশিষ্ট ইংরেজ পুরাতত্ত্ববিদ জেডি বেগলার ‘নোটস অন এ মানভূম থ্রু বেঙ্গল প্রভিন্সেস’ শীর্ষক লেখাতেও দেউলঘাটায় তিনটি ইটের তৈরি দেউলের কথা রয়েছে। আনুমানিক নবম-দশম শতাব্দীতে এই দেউলগুলি গড়ে উঠেছিল। এ গুলি জৈন সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই নির্দশন।’

    সুভাষ আরও জানাচ্ছেন, কংসাবতীর তীরে আনুমানিক নবম-দশম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা একাধিক নিদর্শন রয়েছে। দেউলঘাটার পাশাপাশি বামুনডিহা, জামবাদ, রেলিবেড়া, বুধপুর, ট্যুশামা–সহ নদীতীরের একাধিক জায়গায় জৈন সভ্যতার নির্দর্শন আজও রয়েছে।

    যদিও সেই নিদর্শনগুলি পরবর্তীতে ব্রাহ্মণদের হাতে চলে যাওয়ায় পরে মন্দিরগুলিতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি মেলে।’ দেউলঘাটাতেই মহিষাসুরমর্দিনী, গণেশ ও কার্তিককে পার্বতী, রণচণ্ডীর মূর্তি রয়েছে। একটি পাথর কেটেই তৈরি দশভূজার মূ্র্তি তৈরি হয়েছিল। নির্মাণশৈলী দেখে বোঝা যায়, এই মন্দিরগুলি রেখদেউল শ্রেণিভুক্ত।’

    ২০০২ সালে সংস্কারের কাজ শুরু হলেও তা কিছু দিন পরে বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেই সময়ে নানা জায়গায় পড়ে থাকা পাথরে নির্মিত মূর্তিগুলি চুরি হয়ে গিয়েছে। অনেক মূল্যবান পাথরের খণ্ডও পড়েছিল, যা রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছে।

    তার পরেও মন্দিরের যেটুকু অংশ টিকে রয়েছে, তার গায়ে জৈব চুনের কঙ্ক শিল্পশৈলীর কাজ রয়ে গিয়েছে। পরিপূর্ণ সংস্কার হলে সেই শিল্প ঐতিহাসিক নির্দশন হিসেবে থেকে যাবে।

    গত অর্থবর্ষে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর এই মন্দিরক্ষেত্র সংস্কারের প্রস্তাব রাজ্যের কাছে পাঠায়। দপ্তরের আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলছেন, ‘মন্দির দু’টি দেখে মনে হয়েছিল, দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। তা ভেবেই রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। মন্দিরক্ষেত্রের সংস্কারের জন্য ২ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে।’

    সংস্কারের কাজ করবে পূর্ত দপ্তর। দপ্তরের নির্বাহী বাস্তুকার (সিভিল) কৃষ্ণেন্দু দাশগুপ্তর কথায়, ‘এ ধরনের মন্দির সংস্কারে অভিজ্ঞ সংস্থাই কাজ করবে। দরপত্র ডাকার প্রক্রিয়া শেষ হলে সংস্কারের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। আমরাও এই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’

  • Link to this news (এই সময়)