• সলিল চৌধুরী সঙ্গীতের প্রতি এক বিনম্র মানুষের নাম, তিনি আমাদের ‘আলোর পথযাত্রী’: দেবজ্যোতি মিশ্র
    প্রতিদিন | ২২ জুন ২০২৫
  • জীবনের মিউজিক্যাল জার্নিতে পেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম সলিল চৌধুরীর অসামান্য সান্নিধ্য। তাঁর কাজের কথায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান। এবছরই সলিল চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষ। ২১ জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে গুরু সলিল চৌধুরীর স্মৃতিতে কলম ধরলেন শিষ্য দেবজ্যোতি মিশ্র।

    সলিল চৌধুরী বললেই আমার মনে পড়ে ভারতবর্ষের অন্যতম এক সঙ্গীতকার। এক সরল অথচ ঋজু, দৃঢ় কিন্তু বিনম্র মানুষের কথা। একজন ‘রেনেসাঁ ম্যান’ বা ‘যুগপুরুষ’। তিনি বিস্ময়কর। আমি আমার আঠারো বছর বয়স থেকে প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছি একজন ভায়োলেনিস্ট হিসাবে। সেই আশির দশকের গোড়া থেকে শুরু। যে চোদ্দো বছর ছিলাম তাঁর সঙ্গে, সেসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও মনে হয় যেন সেদিনের কথা। এই তো সেদিন! এই যেন গতকাল! মনেই হয় না এতগুলো বছর চোখের নিমেষে কেটে গিয়েছে।

    সলিল চৌধুরী মানেই এক দৃপ্ত, দৃঢ় অথচ বিনম্র মানুষ। সঙ্গীতের প্রতি তিনি একজন বিনম্র মানুষ। সর্বোপরি মানুষের কাছেও। তাঁর গানের মাধ্যমেই তিনি বহু মানুষের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে পারতেন। সলিল চৌধুরী বললেই আমার প্রথমেই তাঁর কয়্যারের কথা মনে পড়ে যায়। ওঁর গান ও সেই গানের পিছনে আঁকাবাঁকা সেই নদীগুলোই যেন কয়্যার। সেইসব কথা অতর্কিতে মনে পড়ে যায়। আর এর সঙ্গেই মনে পড়ে যায় তাঁর ‘না জানে কিউ’, ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘ আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ এই সব গানের কথা। সেইসব গানের ইন্টারলিউড ও প্রিলিউড কী সাংঘাতিক!

    তাঁর সঙ্গীতে কে না মুগ্ধ হয়েছে? যেমন আমি মুগ্ধ হই, ঠিক সেভাবেই গান করেন না অথচ প্রাণে গান আছে এমন মানুষও মুগ্ধ হয়েছেন। একটা সাধারণ দোকানের রেডিওতেও বাজে সলিল চৌধুরীর কালজয়ী গান। একটা চোঙা মাইকেও ঝলমল করে বেজে ওঠে সেই সব গান। এমনকী তাঁর বেদনার গানও ঝলমল করে বাজে। তার গানের বিষাদ যেন বিষণ্ণ বিষাদ নয়। এই সলিল চৌধুরী আমার কাছে কবি সলিল চৌধুরী, ‘একগুচ্ছ চাবি’র লেখক সলিল চৌধুরী, ‘শপথ’, কবিতার লেখক সলিল চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ মারা যেতে যিনি অশৌচ পালন করেছিলেন!

    সারা পৃথিবীর আলো এসে পড়েছে সলিল চৌধুরীর গানে। বিভিন্ন জায়গার সুর, নিজের দেশের প্রান্তিক জায়গার সুর, সহজিয়া গানের সুর, কীর্তনের সুর, সারা ভারতবর্ষের যে লোকগান তার সুর এবং একই সঙ্গে বেটোফেন, মোৎজার্ট, রাশিয়ান পোলকা ঝলমল করছে তাঁর গানে। আর তাই সলিল চৌধুরী বললেই আমার এই সমস্ত কিছুই মনে হতে থাকে। আরও কত কিছু যে মনে হয় তা বলে বোঝানো মুশকিল! বাংলায় তো অবশ্যই, আমাদের ভারতবর্ষের মধ্যেও তিনিই প্রথম এমন একজন বিস্ময়কর সঙ্গীতকার ।

    রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ের অন্যতম প্রবল ও প্রখর সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী। আমার সকাল-বিকেল, দিনরাত্রি সবটাই সলিল চৌধুরী। যদিও সমস্ত সঙ্গীতকারই আমার প্রিয়। সলিল চৌধুরী ছিলেন শচীন দেব বর্মন ও রাহুল দেব বর্মণের ভীষণ প্রিয়। সুধীন দাশগুপ্তের খুব প্রিয় এক সঙ্গীতকার। এমন কোনও সঙ্গীতশিল্পী নেই যাঁর সঙ্গে তাঁকে কাজ করতে দেখিনি। এমনকী শক্তি চট্টোপাধ্যায়-সলিল চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়-সলিল চৌধুরী, প্রেমেন্দ্র মিত্র-সলিল চৌধুরী এইসব যুগলবন্দি আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমার কাছে সূর্যদ্যুতিসম। এবং এগুলো আমার কাছেই থেকে যাবে। আমি আমার পরের প্রজন্মের সঙ্গীত চর্চায় থাকা ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব এবং এটা শুধুই আমার হয়ে থাকবে সারা জীবন। এগুলো আমার কাছে সোনা বা হিরের থেকে অনেক দামি।

    এই যে বৃষ্টি মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ, সেই সময়ও মনে পড়ে সলিল চৌধুরীর গান। যেমন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া সলিল চৌধুরীর সেই গান ‘ঝির ঝির ঝির বরষা’। এই গানের লিরিকে আছে একটা ভাঙা ঘর এবং সেখানে প্রেম আসে। অথবা ‘এমন সঘন বরষায় তুমি কেন এলে না?’ সেখানেও প্রেমের কিন্তু এক অন্য সংজ্ঞা। বৃষ্টি বাদলার দিনে তিনি যেন বেশি করে মনে পড়েন। হৃদয় মঙ্গেশকরের সুরে একটি গান লিখেছিলেন ‘বাদল কালো ঘিরল গো, সব নাও তীরে ভিড়ল গো।’ এই গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

    সলিল চৌধুরী বললেই মনে হয় একটা গণ অভ্যুত্থানের কথা। বহু মানুষের স্বর জেগে ওঠে। মনে হয় একটা স্বর, একটা ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, যেন এক আলোর পথযাত্রী। হ্যাঁ, সলিল চৌধুরী আমার কাছে একজন আলোর পথযাত্রী। একজন দীর্ঘদেহী আলোর পথযাত্রী। যেন মনে হয় সামনে দিয়ে একটা আলো হেঁটে যাচ্ছে। এটাই সলিল চৌধুরী আমার কাছে। একজন যুগপুরুষ বলতে যা বোঝায়, সেসব কিছুই ছিল তাঁর মধ্যে। যিনি লিখছেন,আঁকছেন, সুর দিচ্ছেন, যিনি ‘দো বিঘা জমিন’ লিখছেন ও চিত্রনাট্য তৈরি করছেন। একই সঙ্গে অনেক কিছুর সমারোহ তাঁর মধ্যে, তিনিই সলিল চৌধুরী।
  • Link to this news (প্রতিদিন)