• লিখন তোমার... ওষুধ বোঝাই দায়! ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন বুঝতে নাজেহাল রোগীকুলের
    এই সময় | ২২ জুন ২০২৫
  • ওষুধ দু’টির ব্র্যান্ডনেমের বানান বেশ কাছাকাছি। তবে ওষুধ দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারবাবু লিখেছিলেন অ্যান্টিঅ্যালার্জিক লিভোসেট্রিজিনের একটি ব্র্যান্ড।

    তবে প্রেসক্রিপশনের হাতের লেখা বুঝতে না-পেরে ওষুধের দোকানদার রোগীকে দিয়েছিলেন অ্যান্টিবায়োটিক লিভোফ্লক্সাসিনের একটি ব্র্যান্ড। স্বাভাবিক ভাবেই অ্যালার্জি সারেনি। বিষয়টি রোগী বুঝতে পেরেছিলেন ফের চিকিৎসকের কাছে আসার পরে।

    অন্য একটি ঘটনায় আবার ওই কাছাকাছি বানানের ব্র্যান্ডনেমের জন্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন রোগী। সেখানেও ভিলেন প্রেসক্রিপশনের হাতের লেখা। ভুল বুঝে, ডায়াবিটিসের ওষুধ গ্লিবেনক্ল্যামাইডের বদলে রোগীর হাতে কেমিস্ট তুলে দিয়েছিলেন পেশির ব্যথানাশক ওষুধ প্যারাসিটামল প্লাস ক্লোরজ়োক্সাজ়োন। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে আসবে কী করে!

    প্রচলিত ধারণা হলো, ওষুধের দোকানি চিকিৎসকের হাতের লেখা ভালো বোঝেন। তবে বাস্তবে এমন ভুল বোঝার নজির অসংখ্য। কেমিস্টেরই যেখানে এই অবস্থা, সেখানে আম রোগীকুলের পরিণতি সহজেই অনুমেয়!

    ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন বোঝার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ অবস্থা শোচনীয়ই। বিষয়টি যে নেহাত ধারণা নয়, বরং ঘোর বাস্তব, তা এবার প্রতিষ্ঠিত হলো এসএসকেএমের একটি স্টাডিতে।

    তাতে দেখা গেল, ডাক্তারের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশনের এক বর্ণও বোঝেন না অন্তত ৩৬% রোগী। প্রায় ৪০% রোগী বোঝেন না ওষুধের ডোজ়। আর প্রায় ৬০% রোগী বুঝতে পারেন না, দিনে কখন, কত বার, কত দিন খেতে হবে কোন ওষুধ!

    এসএসকেএমের ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর টিমের করা ওই স্টাডিটি গবেষণার আকারে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল ফার্মাকোলজি’ বিজ্ঞান পত্রিকায়।

    হাসপাতালের কার্ডিয়োলজি, মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক্স এবং ইএনটি বিভাগের আউটডোরে ডাক্তার দেখাতে আসা ৩৮০ জন রোগীর উপর করা ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাত্র ২০% রোগীই চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন ভালো ভাবে বুঝতে পারেন।

    গবেষকদের উপলব্ধি, যাঁরা ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন প্রেসক্রিপশন ও তার হাতের লেখা, তাঁদের অধিকাংশই ন্যূনতম মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন (৪৪%)। তাঁরা মোটের উপর আর্থসামাজিক ভাবে উপরের দিকে রয়েছেন (৫৭%)।

    সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পঞ্চাশোর্ধ্বদের চেয়ে প্রেসক্রিপশন তুলনামূলক ভাবে ভালো বুঝছেন তাঁরাই, যাঁদের বয়স ৫০ বছরের কম। পুরুষদের বোঝার মান মহিলাদের চেয়ে ভালো।

    ভালো হাতের লেখা প্রেসক্রিপশনের ক্ষেত্রেও ওষুধের ডোজ়ের ইনস্ট্রাকশন হিসেবে লেখা বিডি (দিনে দু’বার), টিডিএস (দিনে তিন বার), এইচএস (শোয়ার আগে) ইত্যাদি টার্মের অর্থ বোধগম্য নয় সাধারণ রোগী-পরিজনের কাছে। গবেষকদের বক্তব্য, এই সব কথার অর্থ রোগী-পরিজনকে মাতৃভাষায় স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে বলার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আরও সচেতন হতে হবে।

    একই মত পাইকারি ও খুচরো ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন বেঙ্গল, ‘কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’–এর মুখপাত্র শঙ্খ রায়চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘ডাক্তারবাবুদের ভালো ভাবে লিখতে বলার অধিকার আমাদের নেই।

    তবে চিকিৎসকরা যদি হাতের লেখার ব্যাপারে একটু যত্নবান হন, তা হলে সকলেরই উপকার হয়। এতে কেমিস্ট তাঁর ভুল এড়াতে পারবেন। এতে আখেরে লাভ হবে রোগীকুলেরই।’ চিকিৎসক মহলের একাংশের বক্তব্য, প্রেসক্রিপশনের এই হাতের লেখা নিয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি)-এর সাফ নির্দেশিকা থাকলেও অনেক চিকিৎসকই তার ধার ধারেন না।

    এনএমসি-র প্রেসক্রিপশন গাইডলাইনের ১.৫ নম্বর ধারায় জানানো হয়েছে, চিকিৎসককে প্রেসক্রিপশনে পরিষ্কার ভাবে লিখতে হবে। জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নয়, লিখতে হবে বড় হাতের (ক্যাপিটাল) হরফে।

    প্রেসক্রিপশন লেখার কালি হতে হবে চিরস্থায়ী। ব্র্যান্ডনেমে ওষুধ লিখলেও বন্ধনীতে তার উপাদানের জেনেরিক নেম লিখতেই হবে যাতে কেমিস্ট কিংবা রোগী, কারও বুঝতে অসুবিধা না হয়। ‘কিন্তু এ সব নিয়ম মানেন ক’ জন চিকিৎসক!’— আক্ষেপ অনেক মানুষেরই।

    ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাম্ব সম্রাট সমাজদার বলেন, ‘এসএসকেএমের এই সমীক্ষাকে সাধুবাদ। কিন্তু বিষয়টি নতুন নয়। এর আগেও এমন স্টাডি হয়েছে। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে থাকাকালীন আমরাও এ রকম সমীক্ষা করেছিলাম। ফলাফল ছিল হতাশাজনক।’

    তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি গত বছর ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ কমিউনিটি মেডিসিন বিজ্ঞাপত্রিকার সম্পাদককে চিঠিও লেখেন যা ছাপা হয়েছিল ওই জার্নালের ‘লেটার টু এডিটর’ কলামে। তিনি চিঠিতে তুলে ধরেন, কেমন হওয়া উচিত আদর্শ প্রেসক্রিপশন।

    তবে এটাও ঘটনা যে বহু চিকিৎসকই রোগীর সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ রক্ষার স্বার্থে মাতৃভাষায় প্রেসক্রিপশন লেখেন। অনেকে ছবি এঁকেও বুঝিয়ে দেন প্রাঞ্জল ভাবে। এমনই এক চিকিৎসক, বিশিষ্ট লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘রোগীর কথাবার্তা আমি যখন বুঝতে পারছি, তখন আমার ডাক্তারি পরামর্শও ষোলো আনা রোগী বুঝতে পারবেন, এমন প্রেসক্রিপশনই হওয়া উচিত। নইলে চিকিৎসার বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় না।’

    স্বাস্থ্য মহল সূত্রে খবর, এই ব্যাধি শুধু এ দেশেই নয়, রয়েছে কমবেশি সারা দুনিয়াতেই। আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ মেডিসিনের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ফি বছর সে দেশে বেঠিক চিকিৎসায় মৃত্যু হয় যে ৪৪ হাজার মানুষের, তার মধ্যে হাজার সাতেক রোগীর মৃত্যু হয় স্রেফ প্রেসক্রিপশন পড়তে না পারার কারণে।

  • Link to this news (এই সময়)