রিয়্যালিটি শো থেকে মঞ্চের অনুষ্ঠান, ‘কভার সং’-এর রমরমা, কমছে মৌলিক গানের বাজার, দায়ী কে?
আনন্দবাজার | ২১ জুন ২০২৫
সঙ্গীতের দুনিয়ায় নেই কোনও কাঁটাতার। ভাষা না বুঝেও গান ছুঁয়ে যেতে পারে শ্রোতার মন। এক সময় মঞ্চে গায়ক কিংবা গায়িকার অভিব্যক্তির থেকে বেশি কদর ছিল গানের কথা ও সুরের। তার দৌলতেই একটি গান জনপ্রিয় হয়ে উঠত দর্শক-শ্রোতা মহলে। বহু বছর হল সেই প্রবণতা বাঙালি পিছনে ফেলে এসেছে। ক্যাসেট থেকে সিডি, নেটমাধ্যম, গানের অ্যাপ— সমস্ত বির্বতনই দেখে ফেলেছে বাংলা গান। গৌতম চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা— এক সময় মুখে মুখে ফিরত মৌলিক গান, তাঁদেরই লেখা, তাঁদেরই গাওয়া।
সময় বদলেছে। এখন চ্যানেলে চ্যানেলে রিয়্যালিটি শোয়ের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা মঞ্চে গান শুনিয়ে মন জয় করছেন শ্রোতাদের। বিচারকদের বাহবাও পাচ্ছেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর জয়ের খেতাব পাচ্ছেন। তার পরেই একের পর এক অনুষ্ঠানের ডাক। সেখানে দর্শকের চাহিদাতেই নাকি গাইতে হচ্ছে হিন্দি গান কিংবা সিনেমার গান, যাকে চলতি ভাষায় বলে, ‘কভার সং’। বাঙালি কি সত্যি মৌলিক গান শোনা ভুলে গিয়েছে? হিন্দি গান ও সিনেমার ভাইরাল গানই বাজার দখল করে নিয়েছে! কেন পিছিয়ে পড়ল মৌলিক গান? না কি বাংলা গানে এখনও আশা রয়েছে নতুন কিছুর? খোঁজ নিল আনন্দবাজার ডট কম।
কলকাতার গানে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের প্রশিক্ষক মানেই রথীজিৎ। এই মুহূর্তে তিনি বাংলার অন্যতম ভাইরাল ‘কিশোরী’ (‘খাদান’ ছবি-খ্যাত) গানের স্রষ্টা। এ ছাড়াও হাতভর্তি সিনেমার কাজ। নিজে অবশ্য রিয়্যালিটি শোয়ের মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন। নিজের পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাঁকে। নিজে এত বছর রিয়্যালিটি শোয়ের প্রশক্ষিক হওয়ার দৌলতে এ কথা একবাক্যে বলেন, ‘‘মৌলিক গান নিয়ে কাজ করাটা প্রয়োজন। কিন্তু, কাজটা ততটা সোজা নয়। আমাদের অনুষ্ঠানে মৌলিক গান গাইয়েছি। হ্যাঁ, সেটা সংখ্যায় খুবই কম। আমি আশাবাদী, এমন একটা সময় আসবে যখন প্রতিযোগিতায় সব নতুন গান গাওয়া হবে। সেই তো বেরিয়ে নতুন গানই গাইতে হবে।’’ কিন্তু সিনেমার গানই একমাত্র ভবিষ্যৎ? রথীজিতের কথায়, ‘‘মানুষ ঝকঝকে উপস্থাপনা পছন্দ করে। এটাই মানুষের মনস্তত্ত্ব। আর মৌলিক গানকে মানুষের কাছে সিনেমার মতো করে উপস্থাপন করার জন্য তো বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সিনেমায় প্রযোজক আছেন। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে লগ্নি করার মতো প্রযোজক কোথায়? একটা নিজস্ব গান করতে গিয়ে লাখখানেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার কোনও আর্থিক লাভ পাচ্ছি না। যদি না কয়েকশো মিলিয়ন ‘ভিউ’ হয়। আসলে মানুষের বিনে পয়সায় গান শোনার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সেটা কমলে গানের সংখ্যা বাড়বে।’’
টাকা বিনিয়োগ করলেই যে সমস্যার সামাধান হবে তা নয়। গানের জগতে ‘পাইরেসি’ যেন খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। যাঁর ফলে মিউজ়িক কোম্পানিগুলোও প্রতি মুহূর্তে এই অসম প্রতিযোগিতা লড়ছে ‘পাইরেসি’র সঙ্গে, মত রথীজিতের। তাঁর কথায়, ‘‘এখন সিনেমায় গান থাকে একটা কিংবা দুটো, ওটিটিতে সিরিজ়ে গান থাকেই না। তাই নিজস্ব গান শোনার জন্য আলাদা একটা দর্শক তৈরি হচ্ছে। আর সেই দিন খুব দূরে নেই।’’
দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে গাইছেন। জীবনে অনেক প্রস্তাব পেয়েছেন রিমেক গান গাওয়ার। প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখনও পর্যন্ত নিজস্ব গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা লোকসঙ্গীতের বাইরে অন্য গান, সোজা কথায় হিন্দি গান গাইতে হয়নি। তিনি লোপামুদ্রা মিত্র। মৌলিক গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনিও যে খুব আশাবাদী সেটা নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সময় ক্যাসেট কোম্পানিগুলোর সাপোর্ট ছিল। সুমন, অঞ্জন, নচি ও আমাকে তারা সাহায্য করেছে। যেটার অভাব রয়েছে এই সময়। মিউজ়িক কোম্পানিগুলো বাংলা গানের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। আর বাংলা মৌলিক গানের তো একটা সংস্কৃতি আছে, সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাঙালি নাচ-গান পছন্দ করতে শুরু করল। এই ভাষায় কিন্তু বিরাট নাচের গান সম্ভব নয়।’’ লোপামুদ্রার কথায়, ‘‘সেই সময় ব্যান্ডের গানকে সাপোর্ট দিয়েছিল আশা অডিয়ো। আমরা আমাদের সেই সময়ের উপর দাঁড়িয়ে এখনও টেনে নিয়ে যাচ্ছি। এখন একটা গান ঝকঝকে উপস্থাপনায় বার করতে খরচ প্রচুর। আমাদের প্রজন্মের ক্ষেত্রে পয়সা খরচ করার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। এ ছাড়াও আমাদের প্রজন্মের লোকেরা, আমরা, যেমন আমি, নচি, শ্রীকান্ত— আমরা মার্কেটিংটা করতে পারিনি। একমাত্র রূপম ইসলাম সেটা পেরেছেন। আর যে পারিশ্রমিক আমি পাই তাঁর চেয়ে বেশি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পায়। তাই খুব খরচ করে গান বানানোর থেকে সেই টাকাটা রেখে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বয়সকালে কাজে আসবে।’’
কিন্তু এখন স্বরচিত গানের খাটনির থেকে হিন্দি গান গেয়ে অর্থ উপার্জনটাই কি সহজ উপায়? লোপামুদ্রার কথায়, ‘‘হ্যাঁ, সেটা তো বটেই। এখনকার বাচ্চা ছেলেমেয়েরাই বা কী করবে! আমরাও তো বিশেষ কিছু করে উঠতে পারছি না। কিন্তু শুধু হিন্দি গান গেয়ে যে নিজের পরিচিতি তৈরি করা যায়, তেমনটাও নয়। আসলে আমাদের নিজেদের ভাষার প্রতি নিস্পৃহতা আছে। আমাদের প্রজন্ম সব সময় অর্থের কথা ভেবেছে, তেমন নয়। আমি এত বছর মৌলিক গান গেয়েই টিকে আছি।’’
বাংলার অন্যতম ক্যাসেট কোম্পানি, বর্তমানে মিউজ়িক কোম্পানি আশা অডিয়োর কর্ণধার অপেক্ষা লাহিড়ী অবশ্য জানাচ্ছেন, তাঁরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মৌলিক গানকে বাঁচিয়ে রাখার। অপেক্ষার কথায়, ‘‘শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত কিংবা কভার সং গেয়ে একটা মিউজ়িক কোম্পানির নিজের পরিচিতি তৈরি হতে পারে না। এখন যে কোনও মাপের শিল্পীর বাড়িতে একটা গান তৈরি করার জন্য যে সরঞ্জাম প্রয়োজন সেটা আছে। যার ফলে তাঁরা বাড়ি বসেই নিজস্ব গান তৈরি করতে পারেন। যখন আশা অডিয়ো সিনেমার বাইরে নিজস্ব গান তৈরি করতে শুরু করল তখন কিন্তু এই সুবিধে ছিল না। আসলে ‘কভার সং’ করলে পরিচিত গান দর্শকের কাছে পৌঁছোনোটা সোজা হয়ে যায়। একটা শোনা গানের গ্রহণযোগ্যতা সব থেকে বেশি। আবার এটাও ঠিক, একটা গায়কের উপার্জনের মূল অর্থ আসে লাইভ শো থেকে। সেটা বেশি সংখ্যায় পাওয়া তখনই সম্ভব, যখন তাঁদের অরিজিনাল গান কিংবা সিনেমার গানের ঝুলি পূর্ণ থাকবে। যেমনটা করছেন ইমন চক্রবর্তী, অনুপম রায়, রূপম ইসলামের মতো শিল্পীরা।’’ তাই অপেক্ষার মতে, চলতি হিন্দি গান কখনওই মৌলিক গানকে কোণঠাসা করতে পারবে না। কিন্তু যে কোনও মিউজ়িক কোম্পানির উপর নতুন প্রতিভাকে খোঁজার, তাঁদের সেই সুযোগ করে দেওয়ার তো একটা দায়িত্ব থাকে। সেই জায়গায় তাই নতুন পদক্ষেপ করছেন তাঁরা। বাংলা ছাড়াও হিন্দি-সহ অন্য ভাষাতেও কাজ করা শুরু করেছেন।
নতুন শিল্পীদের জন্য নতুন একটা প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আসছেন অপেক্ষা। নবাগত শিল্পীরা তাঁদের গান নিয়ে সরাসরি যোগযোগ করতে পারেন তাঁর কাছে, এমনও প্রস্তাব দিলেন অপেক্ষা। মৌলিক গান লোক একেবারেই শুনছে না, মানতে নারাজ অপেক্ষা। তাঁর কথায়, ‘‘নকাশ আজ়িজ়ের সঙ্গে একটা হিন্দি অরিজিনাল প্রকাশিত হয়েছে গত মাসে। মাত্র এক মাসে প্রায় ১৪ লাখ ভিউ হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে মুক্তি পাওয়া কৌশিকী চক্রবর্তীর ‘কিছু কিছু কথা’ প্রায় আড়াই কোটি ভিউ রয়েছে।’’
এই প্রজন্মের জনপ্রিয় গায়ক দুর্নিবার সাহা। রিয়্যালিটি শোয়ের মঞ্চ থেকে উঠলেও সিনেমার গান গাইছেন একের পর এক। শুধু তাই নয়, রাজ্যে ও দেশের বাইরে একাধিক অনুষ্ঠানে গান। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আসর বা বৈঠকে গেয়েছেন বহু বার। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের আশপাশে বহু শিল্পী রয়েছেন যাঁরা কেবল মৌলিক গান নিয়ে চর্চা করছেন। তাঁরা জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন। যে শিল্পীদের বিভিন্ন ধরনের গান রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে মৌলিক গানের গ্রহণযোগ্যতা একটু কম।’’ অর্থ কি একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাংলার বদলে বেশি হিন্দি গান গাওয়ার? দুর্নিবার মানছেন, এটা একটা কারণ। দুর্নিবারের কথায়, ‘‘আসলে ভার্চুয়াল মাধ্যমে হিন্দি, পঞ্জাবি-সহ নানা ভাষার গান দর্শক শুনছেন। আর বিনোদনের উপযোগী গান এখন সর্বত্রই জনপ্রিয় হয়। তাই কিছু ক্ষেত্রে আমাকেও হিন্দি গান গাইতে হয়।’’
দর্শকের অনেকের মত, দুর্নিবারের কণ্ঠ ভীষণ রকম বাঙালি। বাংলা গান মানায় চমৎকার। তিনি নিজেও রিয়্যালিটি শোয়ের প্রতিযোগী ছিলেন। কিন্তু, মাত্র কয়েক বছরে যেন বাংলা রিয়্যালিটি শোয়েও হিন্দি গানেরই আধিক্য। দুর্নিবার অবশ্য জানান, রিয়্যালিটি শো মানে একটা বিরাট আয়োজন, এক বিরাট উপস্থাপনা। যদিও রিয়্যালিটি শোয়ে মঞ্চে মৌলিক গানের বদলে সব সময় পুরনো দিনের বাংলা গান কিংবা সিনেমার প্রচলিত বাংলা গান প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। সেই জায়গায় হিন্দি গানের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সেটা একটা চিন্তার বিষয়। যদিও দুর্নিবার জানান, নিজের অনুষ্ঠানে প্রায় ৯০ শতাংশই বাংলা গান। পুরনো দিনের বাংলা গান, ব্যান্ডের গান সব ধরনেরই গান গেয়েছেন, দর্শক তাঁর গান গ্রহণও করেছেন। শেষে গায়কের সংযোজন, ‘‘বাংলা গানের শিল্পীর সংখ্যা কমে গিয়েছে। তাই নিজের শো নিজের ভাষার গান গাইব না, তাও আবার হয় নাকি!’’
কিন্তু, এই পরিবর্তিত সময়ে হিন্দি গানের রমরমা বাজারে কী ভাবে প্রতিযোগিতায় মৌলিক গান নিজের জায়গা করে নেবে? কিংবা দর্শকদের কাছে সেই গান পৌঁছে দেওয়ার কী কী উপায় হতে পারে, সেই প্রশ্ন রয়েই গেল।