লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ বৃদ্ধিতে কি অন্য প্রকল্পে রাশ
আনন্দবাজার | ২১ জুন ২০২৫
নতুন আর্থিক বছরের শুরু থেকেই খরচে রাশ টানার পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিল রাজ্য সরকার। প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, খরচের দিকটি মাথায় রেখে তবেই প্রকল্প বাছাই করতে বলছে অর্থ দফতর। আর্থিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, খরচের যে বহর ঘাড়ে নিয়েছে রাজ্য, তাতে হাতে টাকা রাখতে এই পদক্ষেপ করতেই হত। আগামী বছরই বিধানসভা ভোট হবে রাজ্যে। ফলে তার আগে বিপুল সংখ্যক মহিলা ভোট নিশ্চিত করতে লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ নিয়ে নতুন কোনও ভাবনাচিন্তা হবে কি না, সেই চর্চাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিশ্লেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, আগে অর্থবর্ষের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে খরচে রাশ টানার চেষ্টা হত। গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে চলতি অর্থবর্ষ (২০২৫-২৬)। তার এক-দেড় মাসের মাথায় এমন বার্তা নিঃসন্দেহে খুবই অর্থবহ।
অর্থ দফতর কোনও কোনও দফতরকে জানাচ্ছে, বরাদ্দ থাকা বাজেটের মধ্যে এমন কোনও প্রকল্প গ্রহণ করা হোক, যা না হলেই নয়। সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এর অর্থ—বাজেট বরাদ্দ যা-ই থাকুক না কেন, অতি প্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাড়া অন্য কিছুর আর্থিক অনুমোদন কঠিন হতে চলেছে। প্রতি বছর ধার শোধ করতে যত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, তা-ও কোষাগারের উপর তীব্র চাপ তৈরি করছে। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি সামনে আসছে, যাতে নতুন করে জনমুখী কোনও প্রকল্প তৈরি বা সুবিধার পরিধি বাড়াতে গেলে অর্থ জোগাড় করা বেশ কঠিন হবে। আবার, রাজনৈতিক শিবিরের চর্চা—প্রতি ভোটের মতো আগামী ভোটেও কিছু চমক রাখতে চাইবে শাসক শিবির। তার অন্যতম হাতিয়ার লক্ষ্মীর ভান্ডার—যে প্রকল্প বিপুল সংখ্যক মহিলা ভোট শাসক দলের অনুকূলে নিশ্চিত করতে অন্যতম অনুঘটকের কাজ করেছে। ফলে সেই প্রকল্পে চালু বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অথচ, এর মধ্যেই বকেয়া ডিএ-র অন্তত ২৫% মেটানোর নির্দেশ রাজ্যকে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাতেও প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের ধাক্কা রয়েছে। তাই সম্ভবত ধারের পাশাপাশি খরচ বাঁচানো ছাড়া আর রাস্তা খোলা নেই সরকারের সামনে। তবে প্রকল্পপিছু খরচ কমানোর সূত্রে পরিকাঠামো ক্ষেত্রটি ধাক্কা খাবে কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।
অভিজ্ঞ কর্তাদের একাংশ মনে করাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই শিল্প সংক্রান্ত উৎসাহ-ছাড় (ইনসেনটিভ) বাতিল করেছে নবান্ন। তার অন্যতম কারণ, ভোটমুখী অনুদান-প্রকল্পগুলি অবাধ রাখা। কারণ, গত বছর লোকসভা ভোটের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মাথাপিছু মাসিক বরাদ্দ বৃদ্ধির পরে তার উপভোক্তা সংখ্যাও ২.২১ কোটি ছাপিয়েছে। ফলে ২০২৪-২৫ (বিগত আর্থিক বছর)-এ লক্ষ্মীর ভান্ডারের খাতে ১৪,৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও, চলতি বছর (২০২৫-২৬) তা এক ধাক্কায় ১২,৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ওই খাতে বরাদ্দ করতে হয়েছে ২৬,৭০০ কোটি টাকা। আবার, ভোটের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে আবাস যোজনা (রাজ্যের নাম—বাংলার বাড়ি, গ্রামীণ) খাতে ১২ লক্ষ উপভোক্তার জন্য রাজ্য বরাদ্দ করেছে প্রায় ১৫,৪৫৭ কোটি টাকা। আগামী ভোটের আগে অতিরিক্ত ১৬ লক্ষ উপভোক্তাকে বাড়ি তৈরি করে দিতে গিয়ে আরও অন্তত ১৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে রাজ্যকে।
প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গড় উৎপাদনের (জিএসডিপি—এ বছর তা ১৮ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে) নিরিখে এখন ধারের মোট পরিমাণ প্রায় ৩৮%। চলতি বছর ঋণের পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৭.৭১ লক্ষ কোটি টাকা। ধার শোধের জন্যও ৮১,৫১০ কোটি টাকা (গত বছরের থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেশি) ধরে রাখতে হচ্ছে সরকারকে।