• খিদে মেটাতেই যদি হয়, সবার নয় কেন: হাইকোর্ট
    এই সময় | ২১ জুন ২০২৫
  • এই সময়: সুপ্রিম-রায়ে চাকরিহারা এসএসসি-র গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি শিক্ষাকর্মীদের মাসিক ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নির্দেশ বহাল থাকবে বলে শুক্রবার জানিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি অমৃতা সিনহা।

    দীর্ঘ রায়ের ব্যাখ্যায় বিচারপতি সিনহা বলেছেন, ‘রাজ্য সরকার এই ভাতা দেওয়ার সপক্ষে যুক্তি হিসেবে সংবিধানের ২১ নম্বর (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার) ও ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদের (শিক্ষার অধিকার, জনসাধারণের সাহায্য পাওয়ার অধিকার) কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই সুবিধা দিতে হলে তা সকলের জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত।’

    কেন এই সমানাধিকারের কথা বলা হচ্ছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিচারপতি। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘একদিকে রয়েছেন মামলাকারীরা, যাঁরা এসএসসি–র নিয়োগের পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিয়োগ পাননি।

    আর অন্য পক্ষ চাকরি পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অসদুপায়ে চাকরি পাওয়ার দায়ে তাঁদের নিয়োগ খারিজ হয়েছে। এই দু’পক্ষই বর্তমানে বেকার। দু’পক্ষেরই অবস্থান বর্তমানে একই। দু’পক্ষই যেখানে ক্ষুধার্ত, সেখানে রাষ্ট্র একপক্ষের মুখে খাবার তুলে দিয়ে অন্যপক্ষকে অভুক্ত রাখতে পারে না।’

    আইনজ্ঞদের একাংশের ব্যাখ্যা, যে হেতু এক্ষেত্রে এসএসসি–র গ্রুপ–সি ও গ্রুপ–ডি পদে ওয়েটিং প্যানেলে থাকা ‘বঞ্চিত’ চাকরিপ্রার্থীরা এই মামলাটি করেছিলেন, তাই ‘অসদুপায়ে’ নিয়োগপ্রাপক বলতে চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীদেরই বোঝাতে চেয়েছে আদালত।

    এই শিক্ষাকর্মীদের ভাতা দেওয়ার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজ্য, তাতে এসএসসি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের মূল রায়কে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা হয়েছে বলেও মনে করে আদালত।

    রাজ্যের উদ্দেশে বিচারপতি সিনহা বলেছেন, ‘কখনও কোনও রায় আপনার পছন্দ না–হতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত, আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা। কারণ, এখনও এই দেশে মানুষ বিচারব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করে, ভরসা করে।’

    আগামী ছ’সপ্তাহের মধ্যে মামলার সংশ্লিষ্ট সবপক্ষকে হলফনামা দিতে বলেছে আদালত। তারপরে মামলার শুনানি শুরু হবে।

    এর আগে রাজ্য আদালতে জানায়, গত ৩ এপ্রিলের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেখানে চূড়ান্ত নির্দেশ না–হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এই ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে।

    যদিও হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, মূল রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনকেই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বলে ধরে নিয়েছে রাজ্য। কোনও মামলায় রায়ের রিভিউ চাওয়া মানে সেটা মামলা ঝুলে থাকা নয়। সেই রিভিউ আবেদন শোনা হবে কি না, তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সেই আদালতই।

    মামলাকারীদের এই মামলা দায়ের করার এক্তিয়ার আদৌ আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল রাজ্য। যদিও বিচারপতি সিনহার পর্যবেক্ষণ— ‘যে কোনও নাগরিকই জনস্বার্থে এমন মামলা দায়ের করতে পারেন।

    কারণ, যেখানে সরকারি ভাঁড়ার থেকে টাকা খরচ করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে যে কোনও নাগরিকের প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে।’ আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে আদালত।

    বিচারপতির যুক্তি, ‘যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয়, এখন হাইকোর্ট এই ভাতা দেওয়ায় অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু ভবিষ্যতে দীর্ঘ শুনানির পরে জানা গেল, এটা বেআইনি ভাবে দেওয়া হচ্ছে, তাহলে কি প্রাপকদের কাছ থেকে সেই টাকা ফেরানোর কোনও রাস্তা আছে?

    আদালতও মনে করে, তাঁরাও (চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীরা) আর্থিক ভাবে দুর্বল।’ তথাকথিত ‘টেন্টেড’ চাকরিহারাদের বেতনের টাকা ফেরানোর নির্দেশ গত বছর দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। সেই নির্দেশে হস্তক্ষেপ করেনি সুপ্রিম কোর্টও।

    এই আবহে শীর্ষ আদালত যাঁদের চাকরি খারিজ করে বেতনের টাকা ফেরানোর কথা বলেছে, তাঁদের উল্টে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ভাবনাকে কটাক্ষ করেছে হাইকোর্ট।

    বিচারপতি সিনহার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘রাজ্য সরকার নাগরিকের মৌলিক অধিকারের কথা বললেও কোনও কাজ না–করে সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা পাওয়া মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। যাঁরা বেআইনি ভাবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে চিহ্নিত করেছে সুপ্রিম কোর্ট, তাঁদের এমন ভাতা দেওয়া হলে তা অন্যায্য সুযোগ পাইয়ে দেওয়া বলেই চিহ্নিত হবে।’

    এরপরেই সমানাধিকারের প্রসঙ্গ তুলে আদালত বলেছে, ‘ভাতা দেওয়ার জন্য এমন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষমতা আছে রাষ্ট্রের। কিন্তু তা কখনওই একপেশে বা একপক্ষের জন্য হতে পারে না। কোনও এক পক্ষের জীবনধারণের সুযোগ করে দিয়ে, অন্যপক্ষকে বঞ্চিত করার কথা সংবিধান বলেনি।’

    বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘রাষ্ট্রের উচিত আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্বকে সমর্থন করা। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে সিলমোহর দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সরকার যে ভাবে এই প্রকল্প তৈরি করেছে, তাতে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তারা বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের যে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে তাকে লঙ্ঘন করেছে।’

    রাজ্য সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদের যে উল্লেখ করেছিল, সে প্রসঙ্গে আদালতের বক্তব্য, ‘প্রকৃতই এই ধারা প্রয়োগ করা হলে, সে ক্ষেত্রে আর্থিক ভাবে দুঃস্থ, শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া, কাজের অধিকার না পাওয়া, এমনকী বৃদ্ধ, অসুস্থ এবং বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য এমন প্রকল্প তৈরি করতে পারত রাজ্য।’

    আদালতের বক্তব্য, রাজ্য চাকরিহারাদের দিয়ে অন্য কোনও বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে তার বিনিময়ে টাকা দেওয়ার কথা ভাবতে পারত। তা না করে ঘরে বসে সরকারি কোষাগারের টাকা পাওয়াকেই রাজ্য উৎসাহ দিয়েছে বলে মনে করে হাইকোর্ট।

    রাজ্যের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার কথাও বলেছে আদালত। বিচারপতি সিনহার বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য রিভিউ পিটিশন করেছে। তা হলে তারা শীর্ষ আদালতের কাছ থেকেই এমন প্রকল্প চালুর জন্য অনুমতি চাইতে পারত, তবে তা চায়নি।

    কলকাতা হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছে বিরোধীরা। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, ‘২০১১ থেকেই মুখ্যমন্ত্রী এই স্টাইলে কিছু জায়গায় রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে ভাতা দেন। এটা অর্থনেতিক ভাবে অপরাধ।

    করদাতাদের টাকা এ ভাবে দেওয়া যায় না।’ ‘বঞ্চিত’ চাকরিপ্রার্থীদের আইনজীবী তথা সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘এই রায় হওয়ারই ছিল। রাজ্য সরকারের এই ঘোষণাই তো বেআইনি।’

    যদিও হাইকোর্টের এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে কারও নাম না–করে বিরোধীদেরই নিশান‍া করেছে তৃণমূল। দলের এক মুখপাত্রর বক্তব্য, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬ হাজার চাকরি খারিজ হয়েছিল। তাতে একদল পৈশাচিক আনন্দ করেছিলেন। যাদের জীবনে যন্ত্রণা নেমে এল, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    রিভিউ পিটিশন হচ্ছে। পাশাপাশি গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি–র যাঁরা আমচকা চাকরি হারিয়ে পথে বসেছিলেন তাঁদের জন্য অন্তর্বর্তিকালীন একটা ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেটা নিয়েও আপত্তি করা হলো। সেটা আটকাতে কারা কোর্টে গেলেন, তাঁদের চিহ্নিত করুন। একটা কথাই বলব, বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও।’

    বিরোধীরা অবশ্য এই যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘আদালত যাঁদের বেতনের টাকা ফেরত দিতে বলেছিলো, তাঁদের কাছ থেকে টাকা ফেরাতে সরকার কোনও উদ্যোগ নেয়নি।

    উল্টে সেই অযোগ্যদেরও মাসে মাসে বিনা কাজে ভাতা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছিল। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) আসলে মানবিকতার নাটক করতে চেয়েছিলেন এটা জেনেই যে, আইনি ভাবে উনি এটা পারেন না।

    অথবা আদালতে এটা খারিজ হয়ে যাবে জেনেও তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। কোর্টের রায়ে সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল।’ প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই প্রক্রিয়া শুরুর আগেই জানতেন যে, এটা বেআইনি। তবু এটা করেছেন। তাই সবথেকে বড় অপরাধী যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।’

  • Link to this news (এই সময়)