এই সময়, মেদিনীপুর: ছেলেকে হারিয়েছিলেন তিনি। ছেলের স্মৃতিতে কিছু করতে চেয়েছিলেন বছর ৭৩-এর বৃদ্ধ। এলাকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই নিজের সন্তানকে দেখতে পান।
তাই তাদের বইমুখী করতে বিদ্যাসাগর গ্রন্থাগার নামে এক গ্রন্থাগার খোলেন দাঁতন-২ ব্লকের প্রত্যন্ত বাবলা গ্রামের হিমাঙ্ক পাল। ইচ্ছা ছিল, এলাকার তরুণ প্রজন্ম এই গ্রন্থাগারে এসে পড়াশোনা করবে। কিন্তু বৃদ্ধর সেই স্বপ্ন এখন ফিকে হয়ে আসছে।
কারণ, গ্রন্থাগার থাকলেও তরুণ প্রজন্মকে সেখানে যেতে দেখা যাচ্ছে না। হিমাঙ্ক জানান, বই পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। একসময়ে বই-এর গন্ধে ঘুম আসত মানুষের। কিন্তু এখন মোবাইল কেড়েছে সে যুগ।
২০০৫ সালের সেই মর্মান্তিক দিন আজও ভুলতে পারেননি হিমাঙ্ক। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনায় ভালো ছেলে সোমনাথ খারাপ সঙ্গে পড়ে বদ নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল। বহু চেষ্টা করেও ছেলেকে ঠিক পথে ফেরাতে পারেননি হিমাঙ্ক।
একদিন ছেলে আত্মঘাতী হয়। মাস ছয়েক কোমায় থাকার পরে ছেলে মারা যায়। এই ঘটনার পরে স্ত্রী অন্নপূর্ণাও হিমাঙ্ককে ছেড়ে চলে যান। নিঃসঙ্গ জীবনে ছেলের স্মৃতিই একমাত্র সঙ্গী।
সেই যন্ত্রণার মধ্যে দাঁড়িয়ে হিমাঙ্ক ঠিক করেছিলেন বইয়ের নেশা ধরিয়ে তরুণ সমাজকে রক্ষা করবেন সর্বনাশা নেশার হাত থেকে। ২০০৯ সালে স্থানীয় একটি ক্লাবে সামান্য কিছু বই নিয়ে শুরু হয় ‘বিদ্যাসাগর গ্রন্থাগার’-এর পথ চলা।
ধীরে ধীরে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজারে। হিমাঙ্কের কথায়, ‘আমার ছেলে না হয় আর ফিরে আসবে না, কিন্তু অন্য কারও সন্তানের যেন নেশার কবলে পড়ে সর্বনাশ না হয়। সেই জন্যই এই পাঠাগার গড়েছি।’
প্রথম দিকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে গ্রামের বধূ, প্রবীণরা বই পড়তে ভিড় করতেন। সপ্তাহে রবিবার ও বৃহস্পতিবার বাদে প্রতিদিন খোলা থাকত পাঠাগার। পাঠকদের সুবিধার্থে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল।
গ্রামবাসী পিঙ্কি পণ্ডা ও সান্ত্বনা দে সামান্য পারিশ্রমিকে এই দায়িত্ব সামলাতেন। কিন্তু দিন দিন বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমতে থাকে। মোবাইল আর সোশ্যাল মিডিয়ার নেশাই এখন বড় বাধা।
স্থানীয় বাসিন্দা তপন জানা বলছেন, ‘হিমাঙ্ক দার উদ্যোগটা সত্যিই মহৎ। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা আর আগের মতো বইমুখো নয়। সবাই মোবাইলে ব্যস্ত। ফলে পাঠাগার ফাঁকাই থাকে।’
গ্রামের প্রবীণ শিক্ষিকা শিখা দাস জানান, ‘যেখানে আজও বই-ই হোক শিক্ষার মূল ভিত্তি, সেখানে এই পাঠাগারটা নতুন প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ করার দিকেই নজর দিতে পারত। কিন্তু সময়ের স্রোতে সেও থমকে যাচ্ছে।’
এখন সেই দুই মহিলা কর্মীও কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তিনি একাই সামলাচ্ছেন সব কিছু। তিনি নিজেই বই গোছান, কেউ এলে বই দেন। কিন্তু পাঠকের সংখ্যা কমে আসায় দিন দিন হতাশা গ্রাস করছে তাঁকে।
‘যখন দেখি কেউ আসে না, খুব কষ্ট হয়। বইগুলো খুলে ধুলি ঝেড়ে রাখি, যদি কেউ আসে। কিন্তু আসে ক’জন?’—আক্ষেপের সুর শোনা যায় বৃদ্ধের গলায়।
গ্রামের যুবক অরুণ পণ্ডা বলেন, ‘হিমাঙ্ক নিজে অনেক চেষ্টাই করছেন। এখন দরকার নতুন ভাবে বই পড়ায় আগ্রহী করার উদ্যোগ। স্কুলে গিয়ে বই বিতরণ, পঠন প্রতিযোগিতা—এ সব করলেই বোধহয় বই পড়বে তরুণ প্রজন্ম।’
বর্তমানে নিজের সামান্য রোজগার আর কিছু মানুষের সাহায্যে গ্রন্থাগার চালিয়ে যাচ্ছেন হিমাঙ্ক পাল। কিন্তু এ ভাবে আর কতদিন টিকবে বাবলা গ্রামের এই পাঠাগার, প্রশ্ন সেখানেই।