‘রবীন্দ্র কাব্য রহস্য’: দুর্বল প্রেক্ষাপট আর কিছু অভিনয় গল্পের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি
আনন্দবাজার | ২০ জুন ২০২৫
খাবার ছাড়া এক জন বাঙালির হৃদয়ে পৌঁছোনোর সবচেয়ে সহজ পথ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার এটাও ঠিক, সবাই যে তাঁকে একশো শতাংশ পুজো করেন, এমনটা নয়। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি হোক বা ‘জনগণমন’ গানের উৎসই হোক, তা নিয়ে বিতর্ক তো কম হয়নি। কিন্তু, ব্রিটিশরা একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ভাবমূর্তি নষ্ট করে ভারতের ‘সফ্ট পাওয়ার’ দুর্বল করতে চাইছে— এই তত্ত্বটা একটু হজম করা শক্ত।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই দাঁড়িয়ে পরিচালক সায়ন্তন ঘোষালের ছবি ‘রবীন্দ্র কাব্য রহস্য’, যেটা শুরু থেকেই ছবির ভারসাম্য নাড়িয়ে দেয়।
ছবির মূল গল্প ১০০ বছরের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া ছ’টি খুনের ঘটনা ঘিরে— তিনটি ১৯২১ সালে, আর তিনটি ২০২১-এ। খুন ও রহস্য মেশানো গল্প হিসেবে ছবিটি একেবারে ফেলনা নয়। কেন্দ্রে আছে একটা চমকপ্রদ ধাঁধা এবং কিছু অপ্রত্যাশিত সংযোগ। গল্পের নায়ক অভীক সেন (ঋত্বিক চক্রবর্তী) এক জন কবি, লেখক এবং রবীন্দ্র গবেষক, যিনি অপেশাদার গোয়েন্দার ভূমিকাও পালন করেন।
এক দিন তাঁর হাতে আসে এক শতাব্দী-পুরনো একটি চিঠি, যেখানে ১৯২১ সালের লন্ডনে ঘটে যাওয়া তিনটি খুনের কথা বলা আছে, আর আছে এক হারিয়ে যাওয়া পান্ডুলিপির সূত্র। সেই সূত্র ধরেই অভীক পৌঁছোন লন্ডনে। গল্পের বড় একটা অংশ সেখানেই এগিয়ে চলে সমান্তরাল ভাবে ১৯২১ এবং ২০২১ সালে।
লন্ডনে অভীকের সঙ্গে পরিচয় হয় রবীন্দ্রসাহিত্য গবেষক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (সুজন মুখোপাধ্যায়), জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিয়া সেন (শ্রাবন্তী) আর সাংবাদিক শালিনী সেনগুপ্তের (বিদীপ্তা চক্রবর্তী)। এই সময়ে অভীকের অনুসন্ধান সূত্রে উঠে আসে আরও তিনটি খুন— ২০২১ সালের লন্ডনে, যেগুলির সঙ্গে ১৯২১-এর ঘটনাগুলির গভীর যোগসূত্র আছে। কী ভাবে, কেন এবং তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া পান্ডুলিপির কী সম্পর্ক, তা জানতে হলে দেখতে হবে ছবিটি।
অভীকে সেনের চরিত্রে ঋত্বিক খুবই বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু, বাকি অনেকের অভিনয়ে কোথাও যেন বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। হিয়া আর অভীকের সম্পর্ক যে ভাবে হঠাৎ করে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তা একেবারেই স্বাভাবিক মনে হয় না। বাকিদের মুখের অভিব্যক্তি, উদ্বেগ কিংবা গাম্ভীর্য এতটাই কৃত্রিম লাগে যে গল্প থেকে মাঝে মাঝে মন সরে যায়। যে কারণে খুনির পরিচয় প্রকাশের দৃশ্যটিও খুব একটা চমকপ্রদ হয়নি। তবে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায় দেখতে যেমন অনবদ্য, তেমনই তাঁর অভিনয়ও যথেষ্ট প্রভাবশালী।
সবচেয়ে বড় খামতি অবশ্য ১৯২১ সালের লন্ডনের প্রেক্ষাপট। সেট আর পোশাক সবই যেন স্টুডিও-ঘেঁষা, যার ফলে ওই সময়ের গভীরতা, ঐতিহাসিকতা সবই ফিকে হয়ে যায়। ছবির গতি নিয়েও অভিযোগ থাকতেই পারে— একই ক্লু বার বার ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেন দর্শক নিজে থেকে কিছু বুঝে উঠতে পারবেন না। এতে টানটান গল্প মাঝেমধ্যে থমকে যায়।
তবে ছবির ধাঁধাটি দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। আর যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এই গল্পে রবীন্দ্রজীবন, তাঁর লেখা আর গানের নানা অনুষঙ্গ সত্যিই রোমাঞ্চকর। বিশেষ করে গানগুলো, যা হলে বসে দর্শককেই গুনগুন করে গাইতে শোনা গেল!
দারুণ একটি ধারণা। কিন্তু তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি দুর্বল অভিনয়, অতিরিক্ত কল্পনা এবং ভঙ্গুর প্রেক্ষাপটের কারণে।