‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।’ বেঞ্চে পাশাপাশি বসে দুলে দুলে কবিতা পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণির কচিকাঁচারা। ফুটো টিনের চাল দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে খুদেদের হাতে ছাতা। এর ছাতা ওর গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে, ওর ছাতা এর গায়ে। সামনে বসে রয়েছেন স্যর। বইয়ের দিকে চোখ। একটা করে লাইন ধরিয়ে দিচ্ছেন তিনি, বাকিটা আওড়াচ্ছে পড়ুয়ারা। শিক্ষকের মাথাতেও ছাতা। হাতে শক্ত করে ধরে আছেন।
পাণ্ডুয়ার পাঁচপাড়া প্রাথমিক স্কুলের এই ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। বৃষ্টির জল পড়ার টুপটাপ, খুদে কন্ঠে ছড়ার সুর আর স্যরের ধমক — সব মিলেমিশে একাকার। ভিডিয়ো দেখে নেটিজ়েনদের অনেকে বলছেন, ‘শিক্ষা ধুয়ে যাচ্ছে।’ শুধু নেটিজ়েনের দলই নয়, শুরু হয়েছে রাজনৈতিক টানাপোড়েনও। পাণ্ডুয়ার পাঁচপাড়া প্রাথমিক স্কুলের ভিডিয়োটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরে শুক্রবার বিজেপি মুখপাত্র অমিত মালব্য সেটি ভিডিয়োটি X হ্যান্ডলে ফের পোস্ট করেছেন। তোপ দেগেছেন শাসক দলকে। তৃণমূল পাত্তা দেয়নি। ত্রিপলের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন।
প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত গুপ্ত বলেন, 'স্কুলে দু'টো পাকা ঘর। দু'টো টিনের চালের। পডুয়া মোট ৬৮ জন। একটা মিড ডে মিলের ঘরও আছে। পাকা ঘরগুলো নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। আকারে একটু ছোট হলেও ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ে না।' তবে টিনের চালের তৈরি ঘরের ক্ষেত্রে জায়গায় জায়গায় যে ফুটো হয়ে গিয়েছে, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন জয়ন্ত। পচে গিয়েছে বাঁশ। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, এমন ঘরে বৃষ্টি হলে আর সামলানো যায় না। গোটা ক্লাসরুম জলে ভেসে যায়। তখন ছাতা ছাড়া বসার উপায় নেই।
জয়ন্তর কথায়, ‘২০২৩ সালে আমি স্কুলে যোগ দিই। তারপর থেকে সব জায়গায় জানিয়েছি। গত বছর ঘর মেরামতির জন্য এস্টিমেট পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছে। আশা করি ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ ভিডিয়ো ভাইরাল হতেই ওই দু'টো ক্লাসরুম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাকা ঘরেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ানো হচ্ছে কচিকাঁচাদের। জায়গা একটু কম, কিন্তু কী আর করা যাবে! যদিও ত্রিপল এসে গিয়েছে।
প্রধান শিক্ষক বলছেন, ‘আপাতত চলে যাবে। অসুবিধা হবে না।’ কিন্তু তাঁর কথা মানতে রাজি নন অভিভাবকরা। শেখ ফিরোজ আলি যেমন স্পষ্টই বলছেন, ‘বর্ষার সময় ক্লাস করা যায় না। বাচ্চাদের পাঠাতে ভয় করে। ওই ত্রিপলে কী হবে!’ গ্রামবাসীরাও একবাক্যে জানাচ্ছেন, বর্ষাকালে এভাবে পড়াশোনা হয় না।
নিজের X হ্যান্ডলে ভিডিয়োটি পোস্ট করে অমিত মালব্য লিখেছেন, ‘কী লজ্জা! এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গের এডুকেশন মডেল। স্কুলের পরিকাঠামো খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় যাচ্ছে?’ রাজ্য সরকারকে বিঁধে তিনি আরও যোগ করেছেন, ‘সরকার যখন তোষণ আর ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকে, তখন বাংলার শিশুদের এই অবস্থাই হয়। গোটা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ন্যূনতম মর্যাদার বালাই নেই, মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এ ভাবে সরকার চলে না। এমন অবহেলা অপরাধ।’
স্কুলের বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হুগলি জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষ। একই সঙ্গে তোপ দাগেন বিজেপিকেও। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনকে সব জানানো হয়েছে। তবে বিজেপির মুখে এ সব মানায় না। ওরা যে সব রাজ্যে ক্ষমতায় আছে, সেখানে নজর দিক। তারপর বাংলার কথা বলবে।’
রাজ্য সরকারের উদ্দেশে তোপ দেগেছে সিপিএমও। পাণ্ডুয়ার সিপিআইএম প্রাক্তন বিধায়ক তথা পাণ্ডুয়া অঞ্চল কমিটির সম্পাদক আমজাদ হোসেনের কথায়, ‘প্রাথমিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা বাধ্যতামূলক। অথচ ঘরের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। আসলে রাজ্য সরকারের নীতি হচ্ছে বাচ্চাদের থেকে বাচ্চার মা-বাবাকে বেশি খুশি করো। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই চৌপাট হয়ে গিয়েছে।’
গোটা বিষয়ের উপর নজর রাখছেন পাণ্ডুয়ার বিডিও শ্রেবন্তী বিশ্বাস। শুক্রবার তিনি জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে পাঁচপাড়া স্কুলের জন্য মোট ১১ লক্ষ টাকার এস্টিমেট দেওয়া হয়। গতকাল (বৃহস্পতিবার) স্কুলে দু'টি ত্রিপলও পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতির উপর নজর রেখেছে ব্লক প্রশাসন।