• মাত্র ১৭ মাসে আত্মঘাতী ৭৪৩ জন! তথ্য দিল পুলিশ
    এই সময় | ২০ জুন ২০২৫
  • চাঁদ কুমার বড়াল, কোচবিহার

    সারি উমর হম, মর মর কে জি–লিয়ে, এক পল তো অব হমে জিনে দো জিনে দো...। থ্রি ইডিয়টস ছবির এই গানটি আজও অনেকের চোখে জল আনে। পড়ুয়াদের নানা ধরনের চাপের মধ্যে পড়ে আত্ম্যহত্যার ইস্যুটি বেশ জোরালো ভাবে উঠে এসেছিল ওই ছবিতে।

    ছবি মুক্তির পরে কেটে গিয়েছে ১৬টা বছর। তোর্সা নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র কমেনি আত্মহত্যার ঘটনা। উল্টে অনেক বেড়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র কোচবিহারে মাত্র ১৭ মাসে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪৩ জন!

    সম্প্রতি হাড়হিম করা এই তথ্য প্রকাশ করেছে কোচবিহার জেলা পুলিশ। আরও চাঞ্চল্যকর বিষয়, যাঁরা আত্মঘাতী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সিংহভাগই কিশোর–কিশোরী। তরুণ–তরুণীর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়।

    কোচবিহারের সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনাগুলির পিছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে উঠে আসছে বিভিন্ন সূক্ষ বিষয়। কোথাও দেখা যাচ্ছে, বাবা মোবাইল কিনে না দেওয়ায় অভিমানে আত্মঘাতী হয়েছে সন্তান।

    কোথাও আবার প্রেমের সম্পর্কে পূর্ণতা না মেলায় একই দড়িতে ঝুলে পড়েছেন প্রেমিক–প্রেমিকা। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কিংবা বাবা–মায়ের সঙ্গে ছোটখাট বিষয়ে ঝগড়া, ‘সামান্য’ কিছুতেই অভিমানে রাগে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার প্রবণতাই কোচবিহারে এত এত মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে।

    বিষয়টা এতটাও সরল নয়। ‘কাবিল’ ছবির ওই সংলাপ মনে করলে, ‘...হর খুদখুশী করনে ওয়ালে কোয়ি না কৌয়ি কাতিল জরুর হোতা হ্যায়।’ এক্ষেত্রে ‘কাতিল’ অর্থাৎ খুনি কোনও ব্যক্তি না-ও হতে পারে।

    পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সামাজিক পরিস্থিতির উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিরঞ্জিত রায় বলছেন, ‘প্রথমত সামাজিক পরিবর্তন একটা বড় কারণ। পরিবার ছোট হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েরা একা বড়ো হচ্ছে। বাবা-মা দু’জনেই ব্যস্ত থাকায় সন্তান কথা বলার সাথী পাচ্ছে না। এগুলো তাদের অল্প বয়সেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে।’

    তিনি আরও বলেন, ‘অল্প বয়সে সন্তানের হাতে মোবাইল দিয়ে দেওয়ার ফলে তারা ওর মধ্যেই বুঁদ হয়ে থাকছে। ইন্টারনেটের যথেচ্ছ ব্যবহার, ধৈর্য কমে যাওয়া, বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া-সহ একাধিক কারণ রয়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার পিছনে।’

    পুলিশ সূত্রে খবর, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোচবিহারে ৪৯৩ জন আত্মহত্যা করেছিলেন। তার মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৩০৪ জন এবং মহিলা ১৮৯ জন। চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসের তথ্য আরও চাঞ্চল্যকর।

    ১৩৮ জন পুরুষ এবং ৮৭ জন মহিলা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন মাত্র ১৫০ দিনের মধ্যে। ভিক্টিমদের মধ্যে ধনী–দরিদ্র, জাতি, বর্ণ, ধর্মের কোনও আলাদা প্যাটার্ন নেই। সর্বস্তরের মানুষই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

    শহরের পাশাপাশি কোচবিহারের গ্রামীণ এলাকাতেও আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এই পরিসংখ্যান কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। জেলা পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্যও উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, ‘প্রায় দেড় বছরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাগুলির তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, বেশিরভাগই আত্মহত্যার ঘটনা।’

    সম্প্রতি মাথাভাঙ্গায় বাড়ির লোকের সঙ্গে মোবাইল কেনা নিয়ে ঝামেলা জেরে এক কিশোরী আত্মহত্যা করে। কোচবিহারের এক নামি স্কুলের ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে একটি বিষয়ে ফেল করায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

    আবার কোচবিহারের সাগরদিঘিতে এক ব্যক্তি আর্থিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেন। শুধু কমবয়সিরাই নয়, প্রবীণ, মাঝবয়সিরাও রয়েছেন আত্মঘাতীর তালিকায়।

    তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই আর্থিক অনটনের জাঁতাকলে পড়ে এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের চিন্তার মূল জায়াগাটাই হলো, আত্মহত্যার ঘটনা আগেও ঘটত। কিন্তু এখন খুব ‘সামান্য’ কারণে মানুষ চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে।

    কোচবিহারের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মলয়কান্তি রায় বলছেন, ‘বর্তমান সমাজে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সীমা অনেকটাই বেড়েছে। তুচ্ছ কারণে সেটা না পাওয়ায় অনেকেই নিজেকে শেষ করে ফেলছেন। মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন এসেছে। চাহিদার সঙ্গে বেড়েছে অভাবও। সর্বোপরি শিক্ষারও একটা প্রভাব এর মধ্যে পড়ছে।’

    আত্মহত্যার ঘটনাগুলিতে সবচেয়ে বেশি গলায় ফাঁস লাগানোর ঘটনা। এছাড়াও বিষ খেয়ে, গায়ে আগুন দিয়ে কিংবা ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বহ মানুষ। এসবের শেষ কোথায়?

    গানের কথায় ফিরলে, গিভ মি সাম সানশাইন, গিভ মি সাম রেইন, গিভ মি অ্যানাদার চান্স... এই চান্স অর্থাৎ সুযোগটা নিজেকেই দিতে হবে, যাতে একবার অন্তত বুকে হাত দিয়ে বলা যায়, ‘অল ইজ ওয়েল’।

  • Link to this news (এই সময়)