সুরবেক বিশ্বাস
কিছুতেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর দেবেন না তিনি। যত বার জিজ্ঞেস করছি, তত বারই তাঁর এক কথা, ‘আমি তো লিখিনি, তুমি লিখেছ। আমাকে কেন টাকা দেওয়া হবে?’ নাছোড় আমি সেই অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে তবেই ছাড়ব, এমন পণ করেছি।
সেটা ২০১৯ সালের শেষ দিক। আমাদের ‘এই সময়’ সংবাদপত্রে সে বছর তত দিনে প্রকাশিত হয়েছে প্রফুল্ল রায়ের একাধিক লেখা। অফিস থেকে বার বার আমাকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে ওঁর সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা জেনে দেওয়ার জন্য। যাতে বরেণ্য সাহিত্যিককে তাঁর লেখার সাম্মানিক সরাসরি ওই অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। উনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। প্রথমে ফোন করলাম বিএসএনএলের ল্যান্ডলাইনে। কথাটা বলা মাত্র আমাকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধুস্স্স্। কীসের টাকা? আমি আবার কোথায় লিখলাম? লিখেছ তো তুমি। যা–ই হোক, এর মধ্যে তাড়াতাড়ি একদিন ফ্ল্যাটে এসো। তোমার সঙ্গে বেশ কিছু দিন দেখা হয়নি।’
ভাবলাম ফ্ল্যাটে গেলে অ্যাকাউন্ট নম্বরটা পেয়ে যাব। আমাদের মেজ়ানিন ওয়ান–এ ফ্ল্যাট থেকে ওঁর ফ্ল্যাট থ্রি ডি–তে যেতে সওয়া মিনিট। বাড়ি তো একই— রিজেন্ট পার্কের আজাদগড়ে ‘হেমন্ত অ্যাপার্টমেন্ট’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই সাত কাঠা জমির উপর তাঁর একতলা বাড়ি ভেঙে এই ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি করান, নামকরণ হয় কিংবদন্তি গায়ক ও সুরকারের নামে)। আসলে প্রফুল্ল রায়ের যে লেখাগুলো সে বছর ‘এই সময়’–তে বেরিয়েছিল, সে সব লেখার কথাগুলো পুরোপুরি ওঁর, তবে উনি বলেছিলেন, আর আমি নোট নিয়ে কম্পোজ় করে ওঁকে দেখিয়ে তার পর কপি ছেড়েছি। তখন মাঝেমধ্যেই ওঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। যাতে ওঁকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যায়, ওঁর যাতে অসুবিধে না–হয়, তার জন্যই ওই ব্যবস্থা। তবে লেখার শেষে অনুলিখন শব্দটা এবং আমার নাম কিছুই দিইনি। এমনিতে লেখাটা তো ওঁরই।
আপিস বেরনোর আগে একদিন দুপুরে ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরের প্রসঙ্গ পাড়তেই প্রথমে নরম ভাবে বললেন, ‘আমি তো বললাম, আমি লিখিনি। আমি শুধু বলেছি আর লেখাটা তুমি তৈরি করেছ। তা হলে আমি কেন টাকা নেব, বলো?’ তাতে কর্ণপাত না–করে আমি ফের জোরাজুরি করতেই চোয়াল শক্ত হলো সেই সময়ে পঁচাশি পেরনো বৃদ্ধের। কড়া গলায় প্রফুল্ল রায় বললেন, ‘জেনে রাখো, কলম না–ধরে আমি আজ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে একটা পয়সাও নিইনি। তাই, আমি টাকা নিচ্ছি না, নিতে পারব না। তোমার অফিসে সেটা বলে দিও।’
তার পর আর অ্যাকাউন্ট নম্বর চাইতে সাহস হয়নি প্রফুল্ল রায়ের কাছে, আমার প্রফুল্ল জ্যেঠুর কাছে।
যেহেতু আমার বাবার (‘চিরঞ্জীব’ ছদ্মনামে খ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক) পেশাও সাংবাদিকতা ও লেখালিখি এবং প্রফুল্ল রায়কে ‘প্রফুল্লদা’ বলে বাবা সম্বোধন করতেন আর বাবাকে উনি নাম ধরে ডাকতেন, তাই আমি বলতাম প্রফুল্ল জ্যেঠু। ২০০৭ সালের এপ্রিলে ‘হেমন্ত অ্যাপার্টমেন্ট’–এ আমাদের ফ্ল্যাট কেনা ইস্তক গর্ব করে প্রফুল্ল রায়ের প্রতিবেশী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে এসেছি। পড়শি হওয়ার সূত্রেই মাঝেমধ্যে ওই ফ্ল্যাটে যাওয়া এবং তাঁর স্নেহ–আশীর্বাদ–ভালোবাসা–উপদেশ পাওয়ার দুর্লভ সুযোগ। আমাকে উপহার দিয়েছিলেন ওঁর দু’টো বই— ‘কেয়াপাতার নৌকো’ এবং ‘যখন যা মনে পড়ে’। এর মধ্যে ‘যখন যা মনে পড়ে’ ওঁর ছোটবেলার স্মৃতির আলোয় লেখা এবং ‘কেয়াপাতার নৌকো’–য় নিপুণ দক্ষতায় আঁকা হয়েছে দেশভাগের যন্ত্রণা ও উদ্বাস্তু জীবনের দুঃখের কথা। প্রফুল্ল রায়ের নিজের তো বটেই, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ তিনটি পর্বে লেখা ওই উপন্যাস।
প্রফুল্ল রায়ের বহু উপন্যাস থেকে তৈরি হয়েছে সুপারহিট সব বাণিজ্যিক ছবি। এর থেকেই বোঝা যেতে পারে, পার্থিব আশা–হতাশা, চাহিদা–বঞ্চনা, ভালোবাসা–বিরহ তাঁর সাহিত্যে কতটা শক্তিশালী ভাবে উঠে এসেছে। অথচ প্রফুল্ল রায় নিজে পার্থিব জগৎ নিয়ে ছিলেন অনেকটাই উদাসীন। মহানায়ক উত্তমকুমারের ‘এখানে পিঞ্জর’ ছবি প্রফুল্ল রায়েরই উপন্যাস থেকে তৈরি। লেখকের কাছ থেকে কাহিনি স্বত্ব কিনতে এলেন প্রযোজক দিলীপ মুখোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, ১০ হাজার টাকা দেবেন আর অগ্রিম বাবদ তার অর্ধেক। কিন্তু প্রফুল্ল রায় বললেন, ‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি এখন টাকা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।’ দিলীপ মুখোপাধ্যায় তখন জানালেন, ঠিকই ধরেছেন সাহিত্যিক, তাঁর আগের দু’টো ছবি ফ্লপ হয়েছে। তখন দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে লেখক বলে দিলেন, ‘তা হলে আপনাকে এখন একটা পয়সাও দিতে হবে না। আগে ছবিটা হোক।’ ছবিটা সুপারহিট হয়েছিল। সেটাই তাঁর উপন্যাস থেকে তৈরি প্রথম ছবি। প্রফুল্ল রায়ের ‘প্রথম তারার আলো’ উপন্যাস থেকেই তৈরি হয় উত্তমকুমারের ‘বাঘবন্দি খেলা’ ছবি। সেই ছবির কাহিনি স্বত্ব কিনতে কত টাকা তিনি নেবেন, খোদ মহানায়কের এই প্রশ্নের মুখে প্রফুল্ল রায় বলেছিলেন, ‘আমি কিছু বলব না। আপনি যেটা ঠিক বলে মনে করবেন, সেটাই দেবেন।’
সাংবাদিকতা জীবনে প্রফুল্ল রায় মোট দু’টি সংবাদপত্রের বিনোদন বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তবে সেই কাজ করতে তাঁর যে খুব উৎসাহ ছিল, তেমনটা নয়। বলেছিলেন, ‘আমার কোনও দিনই ও সব তেমন ভালো লাগেনি। অনুরোধ–উপরোধ করায় ও সব কাজ করেছি। চাকরি ব্যাপারটাই আমার কোনও দিন পছন্দের ছিল না। আমি লিখে রয়্যালটি পাই। আর আমার উপন্যাস থেকে গড়ে বছরে দু’টো সিনেমা, টিভি সিরিয়াল হয়। ওতেই আমার চলে যায়।’ অথচ সাবেক ‘যুগান্তর’ পত্রিকার বিনোদন বিভাগে প্রফুল্ল রায়ের নেওয়া সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল সেই সময়ে।
জীবনে কোনও দিন ডিম, মুরগি, মাংস মুখে তোলেননি প্রফুল্ল জ্যেঠু। আমিষ বলতে কেবলই মাছ। বাড়িতে থাকলে লুঙ্গি–ফতুয়া আর শীতকালে একটা ভারী চাদর। বাড়ির বাইরে বেরোলে সাধারণ ধুতি–পাঞ্জাবি–চপ্পল, অনুষ্ঠান থাকলে ওই পোশাকই একটু ধোপদুরস্ত। কোথাও আড়ম্বর, বাহুল্য, লোকদেখানো ব্যাপার নেই এত টুকুও। আমাদের ওই পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলায় সেই থ্রি–ডি ফ্ল্যাটও একই রকম আড়ম্বরহীন। ওই ফ্ল্যাটের সম্পদ বলতে বই— রাশি রাশি বই। তবে সব চেয়ে বড় সম্পদ তো ফ্ল্যাটের মালিক! আমাদের ওই ২০ ফ্ল্যাটের বহুতলে সবার অভিভাবক ছিলেন যিনি। ৯১ বছর পূর্ণ হওয়ার মাস তিনেক আগে, বৃহস্পতিবার, যিনি না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পরে আমরা তাই অভিভাবকহীন।