এই সময়, খড়্গপুর: ক্লাসরুমের অভাবে ধুঁকছে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। পড়ুয়াদের বসতে দিতে না পারায় একাধিক বিষয়ের ক্লাসও করাতে পারছেন না শিক্ষকরা। এর জেরে সমস্যায় পড়েছে পড়ুয়ারা।
স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্লাসরুমের জন্য টাকা বরাদ্দের আবেদন জানাতে গিয়ে জানতে পারেন, স্কুলকে নাকি ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। স্কুল খরচের হিসেব না দেওয়া পর্যন্ত নতুন করে বরাদ্দ মিলবে না।
অথচ, স্কুল বলছে, ২০ লক্ষ টাকা তো দূরের কথা, এক টাকাও ঢোকেনি স্কুলের অ্যাকাউন্টে বলে দাবি স্কুলের। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর-১ ব্লকের ভেটিয়াচণ্ডী হাইস্কুলের ঘটনা।
এক সময়ে এই স্কুলের তিনটি ব্লক ছিল। একটি ভবন যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় বছর দু’য়েক আগে সেটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ওই ভবনে এক সময়ে পঞ্চম থেকে সপ্তম—তিনটি শ্রেণির ক্লাস হতো।
কিন্তু এখন দু’টি ভবনে পড়ুয়াদের নিয়ে ক্লাস করা মুশকিল। ফলে কম্পিউটার, নিউট্রিশন, মিউজিকের মতো বিভিন্ন ক্লাস নিয়মিত হয় না। আবার কখনও বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পরিত্যক্ত ভবনে ক্লাস করাতে হয় শিক্ষকদের। আতঙ্কে থাকে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী চন্দ্রিকা মাহাতো, প্রিয়াঙ্কা মাহাতোরা বলে, ‘অনেক সময় ভাঙা ঘরে ক্লাস করতে হয়। তখন ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করে। যদি চাঙড় খসে মাথায় পড়ে। এই কারণে আমাদের কম্পিউটার ক্লাস নিয়মিত হয় না।’
একাদশ শ্রেণির ছাত্রী অঙ্কিতা ঠাকুরের কথায়, ‘মাঝে মাঝে পঞ্চম শ্রেণির ছুটি হলে আমরা সেই ঘরে গিয়ে নিউট্রিশন ও মিউজিকের ক্লাস করি। না হলে বেশির ভাগ দিনই ওই ক্লাস হয় না।’
প্রধান শিক্ষক তরুণকুমার শিট বলেন, ‘ক্লাসরুমের জন্য বারবার আবেদন জানিয়েছি। অন্তত ১০টি ক্লাস রুম প্রয়োজন। তার জন্য ৮০ লক্ষ টাকা চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারি সাহায্য না মেলায় কখনও পরিত্যক্ত ভবনে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করতে হয়। কখনও কিছু ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, প্রশাসনিক তথ্য অনুযায়ী, ভেটিয়াচণ্ডী হাইস্কুলকে ২০১৮-১৯ সালে ১৯ লক্ষ ৯০ হাজার ৭৮৫ টাকা টাকা দেওয়া হয়েছিল স্কুল ভবন সংস্কারের জন্য। সেই টাকা খরচের হিসেব দেয়নি স্কুল।
প্রধান শিক্ষক তরুণকুমার শিট বলেন, ‘আমি এই স্কুলে এসেছি ২০২১ সালে। ফলে ওই টাকার কথা জানতাম না। তবু বিভিন্ন নথি ও স্কুলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে দেখেছি, কোথাও টাকা ঢোকেনি।’ বিষয়টি প্রধান শিক্ষক প্রশাসনের নজরে আনার পরেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই টাকা কী ভাবে ও কোথায় খরচ হয়েছে, তা দেখার জন্য তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই টাকা স্কুলে পৌঁছয়নি তা পরিষ্কার হয়েছে।
ফলে জেলা স্কুল পরিদর্শকও (মাধ্যমিক) প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট দেন যে, কোনও টাকা জেলা স্কুল পরিদর্শকের অফিস থেকে স্কুলকে দেওয়া হয়নি। তা হলে ওই বিপুল অঙ্কের টাকা গেল কোথায়? তাও এখনও পরিষ্কার নয়।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও সেই তদন্ত চলছে। তবে এ বিষয়ে জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) স্বপন সামন্ত কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিক্ষা স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র বলেন, ‘বিষয়টি শুনে আমি স্তম্ভিত। আমি চাইব, সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক যদি বিষয়টি আমায় বিশদে জানান, তা হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
স্কুলে টাকা পৌঁছয়নি জানার পরে টাকা খরচের হিসেব সংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্তি পেয়েছে স্কুল। পাশাপাশি জেলা স্কুল পরিদর্শকের অফিস থেকেও প্রশাসনকে জানানো হয়েছে, ওই স্কুলের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসরুমের প্রয়োজন।
ফলে প্রশাসন সম্প্রতি ২৫ লক্ষ টাকা স্কুলকে দেবে বলে সিদ্ধান্তও হয়েছে। যে টাকায় অন্তত একটি ক্লাসরুম, ডাইনিং হল ও মেয়েদের শৌচালয় তৈরির করার জন্য। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ওই টাকায় তো আর ১০টি ক্লাসরুম তৈরি করা যাবে না। ফলে সমস্যা কিন্তু মিটবে না।’
এই স্কুলটির জন্ম ১৯৪৬ সালে। এক সময়ে স্কুলে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করত। এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে ৪০০-তে। অথচ, অন্য স্কুল যেখানে শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে সেখানে এই স্কুলে রয়েছেন ৩৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা।
প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। অভিযোগ, স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা বেশি থাকায় নিজেদের মধ্যে অশান্তিও তীব্র। যা পঠন-পাঠনের পরিবেশ নষ্ট করে। প্রধান শিক্ষকের আফশোস, ‘অতিরিক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন নেই জানিয়ে শিক্ষকদের বদলির জন্যও শিক্ষাদপ্তরকে জানিয়েছি। কিন্তু বদলি না করলে আমার কী করার রয়েছে।’