বিজ্ঞানের অগ্রগতি চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন দিশা, চিকিৎসার জাদুতে শিশুর পুনর্জন্ম...
আজকাল | ১৯ জুন ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: আজ থেকে ঠিক ১৬ মাস আগে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম সূর্যোদয়টা দেখেছিলেন অস্মিকা। সঙ্গে তার 'বাবা মা'র ছিল তাকে নিয়ে তাকে নিয়ে একরাশ স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিন্তু সেই স্বপ্নে বাদ সাধলো তার শরীরে বাসা বাঁধা রোগ, যা 'রেয়ার ডিজিজ' নামে পরিচিত। জন্মের কিছুদিন পরেই তার বাবা মা জানতে পারে 'অস্মিকা'র শরীরে এক ভয়ঙ্কর রোগ বাসা বেধেছে যা সাধারণ পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা করা এবং সুস্থ করে তোলা এক প্রকার অসম্ভব। কারণ তার খরচ বা ব্যয় গগন চুম্বি। কিন্তু তার বাবা-মা ভরসা রেখেছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভরসা রাখলেও চিকিৎসার জন্য টাকার অংকটা যে আকাশছোঁয়া, আর সেই কথা ভাবলেই অস্মিকার বাবা-মা'র আতঙ্কিত হয়ে পরছিলেন। কারণ এত টাকা অর্থাৎ ১৬ কোটি টাকা জোগাড় হবে কোথা থেকে!
নদীয়া জেলার রানাঘাটের ১৬ মাসের কন্যা অশ্মিকা দাস। মেরুদণ্ড সংক্রান্ত বিরল ও মারাত্মক রোগ স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রপি (SMA— Spinal Muscular Atrophy) টাইপ ওয়ান (Type 1)-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সে হয়ে উঠল পূর্ব ভারতের প্রথম শিশু, যে পেয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জিন থেরাপি জোলজেন্সমা (Zolgensma) এবং তা সম্পূর্ণভাবে সাধারণ মানুষের অনুদানের সংগৃহীত অর্থে, অর্থাৎ ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে।মাত্র ৭ মাসে দেশ-বিদেশের প্রায় ৬৫ হাজার মানুষের সহযোগিতায় সংগ্রহ করা হয়েছে ৯ কোটিরও বেশি টাকা। এই বিপুল অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক প্রচার এবং অসংখ্য অজানা মানুষের উদার মনোভাবের জন্য।
এসএমএ টাইপ ওয়ান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য:
এসএমএ টাইপ ওয়ান (SMA Type 1) : ১. এটি একটি বিরল জিন-ঘটিত রোগ, যার ফলে শিশুর পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে অক্ষম হয়। ২. এই রোগের একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা হল জোলজেন্সমা (Zolgensma), এককালীন জিন থেরাপি, যার মূল্য ১৬ কোটি টাকারও বেশি। বিশ্ববিখ্যাত এই ওষুধটি ২ বছর বয়সের আগেই প্রয়োগ করতে হয়, না হলে কার্যকারিতা হ্রাস পায়। ৩. এই চিকিৎসায় ত্রুটিপূর্ণ জিন এসএমএন ওয়ান (SMN1) প্রতিস্থাপন করে রোগের অগ্রগতি বন্ধ করা সম্ভব।৪. স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রপি টাইপ ওয়ান (Spinal Muscular Atrophy Type 1) এমন একটি বিরল জিনঘটিত স্নায়বিক রোগ, যা প্রতি ১০,০০০ শিশুর মধ্যে ১ জনকে আক্রান্ত করে।
উল্লেখ্য, এখানে আশ্চর্যের বিষয়, ভারতে প্রায় প্রতি ৫০ জনের মধ্যে ১ জন এই রোগের বাহক। যদি দুজন বাহক বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সন্তানের এসএমএ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%।২০২১ সালে এসএমএ-কে জাতীয় বিরল রোগ নীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এখনও অর্থ সাহায্য এবং ওষুধ প্রাপ্তি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে।
পিয়ারলেস হাসপাতালে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিশু বিশেষজ্ঞ ও নার্সিং টিমের তত্ত্বাবধানে এই জিন থেরাপি সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়।
আমাদের সংবাদ মাধ্যম আজকাল ডট ইন প্রতিনিধি সরাসরি কথা বলেছিলেন এই চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তা দে, (ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর, শিশু বিভাগ, পিয়ারসেল হাসপাতাল) অস্মিকার বাবা মা সহ একাধিক ব্যক্তিদের সাথে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তা দে বলেন, “পূর্ব ভারতে এই প্রথমবার শুধুমাত্র ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে জোলজেন্সমা (Zolgensma) প্রয়োগ করা সম্ভব হল। এই চিকিৎসা শুধু অশ্মিকার জীবনই বদলে দেবে না, এসএমএ টাইপ ওয়ানে(SMA-1) আক্রান্ত অন্যান্য শিশুদের জন্যও একটা নতুন আশা তৈরি করবে।”
অস্মিকার চিকিৎসা নিয়ে পিয়ারলেস হাসপাতালের এমডি শ্রী রবীন্দ্র পাই বলেন, “এটা শুধু চিকিৎসার গল্প নয়, এটা মানবতার এক অসাধারণ নিদর্শন। আশা করি, এই উদাহরণ ভবিষ্যতে নীতিগত পরিবর্তন আনবে এবং এসএমএ টাইপ ওয়ান-সহ অন্যান্য বিরল রোগের চিকিৎসায় সব স্তরে সক্রিয়তা আরও বাড়বে।”
অশ্মিকার বাবা শুভঙ্কর দাস তার মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে বলেন, “যখন জানতে পারলাম SMA হয়েছে, মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীটাই থেমে গেল, কিন্তু দেশের নানা প্রান্ত থেকে যেভাবে মানুষ এগিয়ে এসেছেন, তাতে নতুন করে বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। আমাদের মেয়ের জীবন ফিরে এসেছে মানুষের ভালবাসায়। পিয়ারলেস হাসতাপাতালকে ধন্যবাদ, এই নতুন জীবন উপহার দিতে সাহায্য করার জন্য।”
বর্তমানে অশ্মিকার নিয়মিত ফলো-আপ, ফিজিওথেরাপি ও পুষ্টির যত্ন চলছে পিয়ারলেস হাসপাতালেই। তার বাবা-মা এসএমএ টাইপ ওয়ান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে ও অন্য পরিবারকে সহায়তা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বলাবাহুল্য, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে সচেতনতা, সহমর্মিতা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে বিরল রোগের চিকিৎসাও এখন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে এক বিরল দৃষ্টান্তের সাক্ষী থাকলো কলকাতা পিয়ারলেস হাসপাতাল