• বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি বলে সন্দেহ! হেনস্থা এড়াতে হিন্দি শিখতে মরিয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা
    আনন্দবাজার | ১৮ জুন ২০২৫
  • ‘সামাল’ নয়, কথাটা ‘সামান’!

    প্রতি দিন সন্ধ্যার পরেই পরিযায়ী শ্রমিকদের বস্তিতে কান পাতলে শোনা যায় এমন নানা শব্দের ব্যবহার। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, কী হচ্ছে। তবে ভিতরে গেলেই দেখা যাবে, বস্তির কোনও এক ফাঁকা জায়গায় গোল করে বসে আছেন কয়েক জন। আর তাঁদের হিন্দি শেখাচ্ছেন এক জন। শ্রমিক ছাত্রেরা বার বার ভুল উচ্চারণ করছেন, আর তা শুধরে দিচ্ছেন শিক্ষক!

    বাংলা বললেই বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগে সরগরম গোটা দেশ। মুর্শিদাবাদের বাংলাভাষী শ্রমিকেরা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে। শুধু তা-ই নয়, পরিচয়পত্র দেখিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। পরিযায়ী শ্রমিকেরা মনে করছেন, জড়তাহীন, স্পষ্ট হিন্দি উচ্চারণই হেনস্থা থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা। তাই কাজ সেরে ফেরার পরে বস্তির হিন্দি শেখার পাঠশালায় যোগ দিয়েছেন শ্রমিকেরা। হিন্দিভাষী ঠিকাদারেরা ওই পাঠশালার শিক্ষক।

    ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্র, ওড়িশা-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশি সন্দেহে মুর্শিদাবাদের পরিচয়ধারী শ্রমিকদের হেনস্থার ১০০টিরও বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ করেও কোনও লাভ হয়নি বলেই দাবি শ্রমিকদের। অনেকে ভিন্‌রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে আতঙ্কে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই মুর্শিদাবাদের বাংলাভাষী শ্রমিকেরা এখন হিন্দি শিখতে মরিয়া।

    ভারতে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে দেশ জুড়ে। তার পরে তাঁদের ভারত থেকে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশে। মহারাষ্ট্র, দিল্লি, ওড়িশা-সহ দেশের একাধিক রাজ্যে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চিহ্নিতকরণের কাজে কিছু ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী ভূমিকাও নিতে দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ। এ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিও তোলপাড়। শুধুমাত্র ভাষার নিরিখে বাংলাদেশি তকমা দেওয়ার নেপথ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। সোমবার সেই প্রসঙ্গ টেনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিজেপিকে দুষেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার অভিযোগ, শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে!

    মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের একাংশের অভিযোগ, ওড়িশায় ফেরিওয়ালার কাজ করা প্রায় ৩০ জনকে শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধে’ অবৈধ বাংলাদেশি বলে হেনস্থা করা হয়। উত্তরপ্রদেশের কুশীনগরে মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়ার বেশ কিছু পরিচিত শ্রমিককে স্থানীয় লোকজন বাংলাদেশি দাবি করে মারধর করেন। মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলায় তাঁদের সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরে আহত অবস্থায় ওই শ্রমিকদের পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নেয়। পরে ছেড়েও দেয় পুলিশ।

    মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থেকে ওড়িশায় নির্মাণকাজে যাওয়া ৬০ জন পরিযায়ী শ্রমিক ময়ূরভঞ্জ জেলার জসিপুরে পৌঁছোনোর পর স্থানীয়দের সন্দেহের শিকার হন বলেও অভিযোগ। এমন ঘটনা দেশে কম নেই। প্রয়োজনীয় সমস্ত নথি দেখিয়েও রেহাই পাননি মুর্শিদাবাদের শ্রমিকেরা। বাংলাদেশি সন্দেহে একের পর এক হেনস্থার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে।

    পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের প্রধান আসিফ ফারুকের কথায়, “রুটি-রুজির জন্য ভিন্‌রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া নিরীহ শ্রমিকদের শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে হেনস্থা করা হচ্ছে। আধার, প্যান কার্ড-সহ একাধিক পরিচয়পত্র দেখিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। ভারতীয় নাগরিক হয়েও কেবলমাত্র ভাষা এবং ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে।”

    অভিযোগের কথা স্বীকার করে নিয়ে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মৈত্র বলেন, ‘‘প্রতিটি ঘটনায় জেলা এবং রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছি আমরা।’’ তৃণমূল সাংসদ সামিরুল ইসলামের দাবি, ‘‘এ বার থেকে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা যে অভিযোগ তুলছেন, তা ভাল ভাবে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’’ বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে রাজ্যের শাসক দল।

    যদিও বিজেপির দাবি, গোটাটাই তৃণমূলের ‘পাপের ফল’। বিজেপির অভিযোগ, ‘‘অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিকদের বৈধ পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার দুষ্টচক্রকে মদত দেওয়ার ফল ভুগছে এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ। এ জন্য দায়ী তৃণমূল সরকার। তৃণমূলের পাপের ফল ভুগছে কয়েকটি জেলার পরিযায়ী শ্রমিকেরা।’’

    দীর্ঘ দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের একাধিক রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করা মুর্শিদাবাদের সুতি ব্লকের হানিফ, আকমাল, রহমানদের মতো হেনস্থার শিকার হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা এখন তাই ব্যস্ত হিন্দি ভাষা শিখতে। উত্তরপ্রদেশের কানপুরে কাজ করা মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি ব্লকের সরকারপাড়া এলাকার পরিযায়ী শ্রমিক জব্বার মণ্ডলের কথায়, ‘‘এত দিন কাজ করছি, কোনও দিন ভাবিনি হিন্দি শিখতে হবে। বাংলা বললেই বাংলাদেশি বলে চরম হেনস্থা করা হচ্ছে। হিন্দি শিখলে হয়তো এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া যাবে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)