বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচের স্বচ্ছতায় বিধানসভায় পাস বিল, আনা হল ১৬টি সংশোধনী
প্রতিদিন | ১৮ জুন ২০২৫
স্টাফ রিপোর্টার: বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে চিকিৎসায় স্বচ্ছতা বাড়াতে ও বাড়তি খরচে রাশ টানতে পুরনো আইন সংশোধন করল রাজ্য সরকার। ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট (সংশোধনী) বিল’ মঙ্গলবার বিধানসভায় পাস করে স্বাস্থ্য রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলে দেন, “কোন চিকিৎসার জন্য কী খরচ হল, রোগীকে তা জানাতে বাধ্য থাকবে বেসরকারি হাসপাতাল। বেসরকারি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতেই আইনে সংশোধন করা হল।” বিলের কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর দাবি, বিলে মহিলা চিকিৎসক, রোগীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির বিষয়ে কোনও কথা বলা নেই। শুভেন্দুর অভিযোগের জবাবে চন্দ্রিমা বলেন, আইনে এই সংশোধন বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমের চিকিৎসায় খরচে স্বচ্ছতার জন্য। চিকিৎসা খরচের প্যাকেজ রোগীর সুবিধার জন্য ‘ডিসপ্লে’ করার কথাও জানানো হয়েছে।
এই বিলে সংশোধনী কেন দরকার তার ব্যাখ্যায় মন্ত্রী চন্দ্রিমা স্পষ্ট জানান, চিকিৎসার খরচের বিলে নানারকম খরচের কথা উল্লেখ থাকে। রোগী হয়তো ২ লিটার জল খেয়েছে। কিন্তু বলা হল ২০ লিটার জল খেয়েছে। ৫টি ইঞ্জেকশন দেওয়া হলেও হয়তো বলা হল ২০ টি দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সঠিকটা কী সেটা জানাতে হবে।
তাঁর কথায়, “রোগীকে জানাতে হবে, তার ঠিক ঠিক কীসের জন্য কী খরচ হল। লুকিয়ে কিছু করা যাবে না। দু’দিন বেশি থাকতে হলে হবে। সে ক্ষেত্রে বিল বাড়তেই পারে। তাই বলে তার বিপুল খরচ হতে পারে না। খরচের পুরো হিসাব দিতে হবে। কোন অসুখে কী চিকিৎসা, তার কত খরচ, সেটা জানাতেই হবে।”
বিলে ১৬টি সংশোধনী আনা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। সঙ্গে বিরোধী দলনেতার দাবির পালটা চন্দ্রিমার জবাব, “বেসরকারি হাসপাতালে মহিলা রোগী ও কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দেখতে হবে।” তাঁর বক্তব্য, “এই নিয়ে সরকার গাইডলাইন তৈরি করে দিতে পারে না।”
চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্যাকেজ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শুভেন্দু। তাঁর কথায়, “এই বিলে প্যাকেজ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলি রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে না-পারে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কারণ ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ রোগী এই প্যাকেজে চিকিৎসা করাতে পারবেন। কিন্তু ২ থেকে ৫ শতাংশ রোগী এই ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন না। তাঁদের দায়িত্ব কে নেবে, সেটা স্পষ্ট করা হয়নি।” সঙ্গে তাঁর আরও দাবি, বিষয়টির সঙ্গে বহু বেসরকারি হাসপাতাল, ডে-কেয়ার ইউনিট এবং ওপিডি যুক্ত। তাই স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে বিলটি পাঠিয়ে সমস্ত অংশীদারের মতামত নিয়ে তার পর বিল পাস করানো উচিত ছিল। প্রশ্ন ওঠে নার্সিংহোমগুলির লাইসেন্স নিয়েও।
কোথায় কোনও হাসপাতালকে সরকার ১ টাকার বিনিময়ে জমি দিচ্ছে, তার বদলে কোন রোগী কোন পরিষেবা পাচ্ছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে বিজেপি। মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যর জবাব, “এটা ট্রেড লাইসেন্স ফি-র বিষয় না, রোগী পরিষেবার প্রশ্ন। এটা নিয়ে সরকার কী বলবে, সেটা ঠিক করতে হবে হাসপাতালকেই।”
বিরোধী দলনেতার আরও অভিযোগ ছিল, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেহাল। বছর ঘুরলেই বিধানসভা ভোট। তাই নজর ঘোরাতে তড়িঘড়ি এই বিল আনা হয়েছে। বিলে মহিলা চিকিৎসক, রোগীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলেও অভিযোগ করেছিলেন শুভেন্দু। নয়া বিলের ই-প্রেসক্রিপশনে পাবলিক ডোমেনে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শুভেন্দু। চন্দ্রিমার জবাব, “ই-প্রেসক্রিপশনে পাবলিক ডোমেনে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। এটা রোগী নিজেই পাবেন।” শুভেন্দুকে চন্দ্রিমার কটাক্ষ, “বিরোধী দলনেতার নেতা প্রধানমন্ত্রী মোদি ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলছেন। আর বিরোধী দলনেতা ই-প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিরোধিতা করছেন। তা হলে ডিজিটাল ইন্ডিয়া কোথায়?” তাঁর সংযোজন, “তড়িঘড়ি করে বিল আনা হয়নি। মানুষের স্বার্থেই আনা হয়েছে। কাউকে আমরা অসম্মান করছি না।”
বিজেপির মুখ্যসচেতক শঙ্কর ঘোষ বিলে একাধিক সংশোধনীর প্রস্তাব দেন। কিন্তু সবকটি সংশোধনীই খারিজ হয়ে যায়। আলোচনা চলাকালীনই আবার বিধায়ক নির্মল মাজি ‘কিছু রাজনৈতিক নেতা’-কে ইঙ্গিত করে নার্সিংহোমে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। বাম আমলের আগে থেকে এই অবস্থা চলছে বলে তাঁর বক্তব্য, “কিছু রাজনৈতিক নেতার মদতে নানা জায়গায় নার্সিংহোম গজিয়ে উঠেছে। অনেক সময়ই খবর পাওয়া যায়, যেখানে একটি সিটি স্ক্যান দরকার, সেখানে ৩ বার করা হচ্ছে। ভেন্টিলেটরে মৃতদেহ রেখে দেওয়া হয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি দরকার নেই, তাও করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক দরকার না হলেও দেওয়া হয়। পরে সেগুলোই ফার্মাসিতে ফিরে আসে।” শুভেন্দুর অভিযোগ, “এই আইন পাস করার পরে হাসপাতালগুলো থেকে আরও বেশি টাকা তুলবে তৃণমূল। আর হাসপাতালে স্টাফ হিসাবে নিজেদের ছেলেদের ঢোকাবে।”
এই সংশোধনী বিল নিয়ে পূর্ব ভারতের বেসরকারি হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তথা উডল্যান্ডস মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতালের ডিরেক্টর এবং সিইও রূপক বড়ুয়া এদিন জানিয়েছেন, “ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট সংশোধনী বিলে যা রিভাইসড করা হয়েছে সেখানে অনেক বেশি স্বচ্ছতা আনা হয়েছে। রোগীর পরিবারের কথা ভেবে বিলের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতাল সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে যতটুকু ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে, আশা করছি নয়া আইনের পর তা কেটে যাবে।” তাঁর কথায়, “নয়া আইনে বলা হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে প্যাকেজ-রেট ডিসপ্লে বোর্ডে লিখে রাখতে হবে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এতে স্বচ্ছতা বাড়বে। সাধারণ মানুষের উপকার হবে। হাসপাতালের প্যাকেজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে কখনওই যেন চিকিৎসার খরচ প্যাকেজের থেকে বেশি না হয়ে যায়। এটা একদিকে ভালো। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট বিষয়টা অত্যন্ত ডায়নামিক বা পরিবর্তনশীল। কারও চিকিৎসা শুরু হলে ডাক্তারের মূল লক্ষ্য থাকে রোগীকে সুস্থ করে তোলা। প্যাকেজের বাইরেও কোনও চিকিৎসা রোগীর প্রয়োজন হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে সেটাকে আবদ্ধ করে রাখা মুশকিল। তবে যে সব ক্ষেত্রে রোগীর জটিলতা তৈরি হয় না সেখানে অসুবিধা নেই।”
শেষে তাঁর দাবি, “এসব ক্ষেত্রে পরে যখন রিভিউ করা হবে তখন যেন নিরপেক্ষভাবে রিভিউ করা হয়। কেন রোগীর চিকিৎসা খরচ প্যাকেজের থেকে বেশি লাগল সেটা যেন সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা হয়। রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। তাঁদেরকে অন্ধকারে রাখা যাবে না।”