দিব্যেন্দু অধিকারী
দু’টো সিটের মাঝখানে সামান্য একটু ব্যবধান। সিটে বসতে হয় হাঁটু মুড়ে। একটু লম্বা লোক হলে সামনের সিটের সঙ্গে হাঁটু লেগে যায়। বাস হঠাৎ ব্রেক কষলে হাঁটুতে চোট লাগার সম্ভাবনা থাকে। সিটের আয়তন যতটা হওয়া উচিত, অনেক বাসেই সেটা থাকে না। দু’জনের বসার সিট হলেও তাতে মেরেকেটে দেড়জন লোক বসতে পারেন। ফলে সিটে বসা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে রোজ ঝামেলা লেগেই থাকে।
কোনও কোনও বাসের পাদানি এতটাই উঁচু যে, লাফ দিয়ে বাসে উঠতে হয়। অনেক বাসের দরজা সঙ্কীর্ণ হওয়ায় ওঠানামা করতে অসুবিধা হয়। সমস্ত বাসেই ফার্স্ট এইড বক্স রাখার কথা। কিন্তু সেই ন্যূনতম শর্তটুকু মানছেন না অনেকে। মানা হচ্ছে না কোনও টাইম টেবিল। চালক ও কন্ডাক্টররা নিজেদের মর্জি মতো বাস ছাড়ছেন। ফলে বাসে যাতায়াত করতে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। বিকল্প হিসেবে অনেকে টোটো, অটো এবং ইঞ্জিন ভ্যানকে বেছে নিচ্ছেন।
রাস্তায় টোটো ও অটোর দৌরাত্ম্য বন্ধের দাবি জানিয়ে গত সোমবার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন আরামবাগের বাস মালিকরা। যদিও যাত্রীদের একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, বাস মালিকরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় আন্দোলন করছেন ভালো কথা, কিন্তু বাসযাত্রীরা কী ধরনের অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেটা কি তাঁরা কোনও দিন ভেবে দেখেছেন? তাঁদের দাবি, বাস মালিকরা যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর না দেওয়াতেই লোকজন টোটো–অটোর দিকে বেশি করে ঝুঁকছেন।
আরামবাগ–গোঘাট–কামারপুকুর রুটের নিত্যযাত্রী শ্যামলী ঘোষ বলেন, ‘বাস মালিকরা শুধু নিজের কথাই ভাবেন। যাত্রী সুরক্ষার দিকে কোনও নজর নেই। সিটগুলোতে ভালো করে বসা যায় না। যিনি সাইডে বসেন, তাঁর শরীরের অর্ধেকটা বাইরে বেরিয়ে থাকে। পাদানি উঁচু হওয়ায় বাসে উঠতে গিয়ে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন।’
গোঘাটের বাসিন্দা রূপালী সর্দার বলেন, ‘অফিসে টাইমে বাসে গাদাগাদি করে লোক তুলে নেয়। বাসের ভিতরে দাঁড়াবার জায়গাটুকু থাকে না। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ মহিলাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। তাই বাসে উঠতে ভয় করে। তার থেকে টোটো কিংবা ইঞ্জিন ভ্যান অনেক বেশি আরামদায়ক।’
আরামবাগের বাস ও মিনিবাস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদিকা মধুমিতা ভট্টাচার্যের যুক্তি, ‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ১৫ বছরের পুরানো বাস হলে বছরে দু’বার ফিটনেস পরীক্ষা করাতে হয়। বাকিদের ক্ষেত্রে বছরে অন্তত একবার সিএফ করাতে হয়। বাসে কোনও সমস্যা থাকলে তাতে ধরা পড়ার কথা।’
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও লোকজন টোটো, অটো এবং ইঞ্জিন চালিত ট্রলি ভ্যানে যাতায়াত করছেন। তার অধিকাংশই বেআইনি। যেহেতু এর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের রুটি–রুজি জড়িত, তাই মানবিক কারণে তঁাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’
আরামবাগের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র কামারপুকুরে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পৈত্রিক বাড়ি। প্রতিদিন বহু মানুষ কামারপুকুরে বেড়াতে আসেন। তাঁদের অনেকেই ট্রেনে করে প্রথমে গোঘাট স্টেশনে আসেন। সেখান থেকে সড়ক পথে কামারপুকুরে যান। অভিযোগ, গোঘাট স্টেশনে নেমে অধিকাংশ সময়ে বাস পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই লোকজন টোটো কিংবা ইঞ্জিন ভ্যানে চড়ে কামারপুকুর যান।
আরামবাগের মায়াপুর–গড়ের ঘাট, মুথাডাঙ্গা–বর্ধমান, কাবলে–মলয়পুর, হরিণখোলা–কৃষ্ণপুর, আরামবাগ– বন্দর, খানাকুলের চক্রপুর–গণেশপুর, সোদপুর–খুশিগঞ্জ–সহ বহু রুটে অটো, টোটো ও ইঞ্জিন ভ্যানের দাপটে বাসের সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। আরামবাগ–জয়রামবাটি, আরামবাগ–তিরোল, আরামবাগ–কুমারগঞ্জ, আরামবাগ-কোটা–পাবা ভায়া গোঘাট, তারকেশ্বর–চব্বিশপুর রুটে বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। সেখানে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা টোটো ও ইঞ্জিন ভ্যান।
আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল করে। যাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, আরামবাগ বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের বসার কোনও জায়গা নেই। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা। পুরসভা থেকে জলের এটিএম বানানো হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই সেটা বিকল হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি হলেই বাসস্ট্যান্ডে জল দাঁড়িয়ে যায়। রাত হলেই বাসস্ট্যান্ডে যৌনকর্মীদের আনোগোনা বেড়ে যায়। মাঝে মধ্যেই পকেটমারি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ফলে রাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন যাত্রীরা।