গৌতম ধোনি, পলাশি (কালীগঞ্জ)

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ককে ডান হাতে রেখে সরু যে রাস্তাটি বাঁ দিক বরাবর চলে গিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে একটুখানি এগোলেই ঐতিহাসিক পলাশির প্রান্তর। এর ডান দিকে পলাশি যুদ্ধের স্মারকস্তম্ভ, বাঁ দিকে সেই আমবাগান।

ওই স্মারকস্তম্ভের গা ঘেঁষে যে চায়ের দোকান, মঙ্গলবার সকালে সেখানে বেশ ভিড়। আড্ডায় মশগুল যুবক–প্রৌঢ়–বৃদ্ধের দল। এ দিনই ভোটের শেষ প্রচার বলে কথা। ওই আড্ডায় কান পাতলে ভোটের হাওয়া কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। সেই আশায় দোকানে সেঁদিয়ে বোঝা গেল ভোট নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই। আড্ডার টপিক— ইজ়রায়েল–ইরান যুদ্ধ। পাশে বসা এক বৃদ্ধকেই জিজ্ঞাসা করা গেল— ‘ভোটের হাওয়া কেমন কত্তা?’ মুখ তুলে দেখলেন। একটু থেমে বললেন, ‘ভোটের কথা রাখেন ভাই।’

ওই দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই সঙ্গি হলেন সেই বৃদ্ধ। আশেপাশে কেউ নেই দেখে আগবাড়িয়ে নিজেই বললেন, ‘ভোটের কথা যদি বলেন, তা হলে এই মাটিতে কে কার ঘরের শত্রু, চেনা খুবই শক্ত। মিরজাফরেরা লাল–সবুজ–গেরুয়া সব দলেই আছেন। একটু ঘুরুন, কথা বলুন এর–ওর সঙ্গে, টের পাবেন।’

পলাশি নদিয়ার কালীগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত। রাত পোহালে, বুধ–সকালে এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন। তৃণমূলের প্রার্থী প্রয়াত তৃণমূল বিধায়ক নাসিরুদ্দিন আহমেদ ওরফে লাল–এর মেয়ে আলিয়া আহমেদ। বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী কংগ্রেসের কাবিলউদ্দিন শেখ। বিজেপি প্রার্থী আশিস ঘোষ। কালীগঞ্জ ব্লকের ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৩টি পঞ্চায়েত নিয়ে এই বিধানসভা এলাকা।

একে উপ নির্বাচন তার উপর সংখ্যালঘু প্রভাবিত এলাকা। কিন্তু লড়াইটা জোড়াফুল শিবিরে পৌঁছে দিতে ১৩টি পঞ্চায়েতেই একজন করে ওজনদার নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপি। রানাঘাট উত্তর–পূর্ব কেন্দ্রের বিধায়ক অসীম বিশ্বাস বললেন, ‘১১ দিন ধরে দেবগ্রাম পঞ্চায়েতে মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছি।’

রানাঘাট উত্তর–পশ্চিমের বিধায়ক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গেল কালীগঞ্জের জুড়ানপুর পঞ্চায়েত এলাকায়। চাকদহের বিধায়ক বঙ্কিম ঘোষ রয়েছেন মাটিয়ারি পঞ্চায়েত এলাকায়। কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক আশিস ঘোষের দায়িত্বে রয়েছে কালীগঞ্জ পঞ্চায়েত। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর এখানকার বড় চাঁদঘর পঞ্চায়েত ভোটের কাজ তদারকি করছেন।

তা হলে ভোটের ফল কী হবে? পদ্ম–প্রার্থী আশিস বলছেন, ‘আমাদের মূল প্রতিপক্ষ তৃণমূল। সাতটি পঞ্চায়েতে লিড দেবে বিজেপি। মোট কথা জয় নিশ্চিত।’ দেবগ্রাম এলাকায় বাম-কংগ্রেস তো বটেই, আশিসের নিজের দলের একাংশও বলছেন এই পঞ্চায়েতে তিনি তৃণমূলের সঙ্গেই ঘর করেন! বিজেপির টিকিটে জিতে মেম্বার এটা ঠিক। কিন্তু তৃণমূল পরিচালিত দেবগ্রাম পঞ্চায়েতে কৃষি ও প্রাণীসম্পদ বিষয়ক সঞ্চালকের দায়িত্বে রয়েছেন আশিসই! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার প্রচারে বিজেপি প্রার্থীকে নিয়ে এই তোপই দেগে গিয়েছেন। এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে বিজেপির পুরোনো লোকেদের এখনও প্রচারে নামানো যায়নি।

এক সময়ে কালীগঞ্জ বিধানসভা বাম শরিক আরএসপির দখলে ছিল। ২০১১–র ভোটে তৃণমূলের লাল আরএসপি প্রার্থীকে হারিয়ে বিধায়ক হন। ২০১৬–র ভোটে জয়ী হন বাম-কংগ্রেস প্রার্থী হানানুজ্জামান। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। ২০২১–র ভোটে নাসিরুদ্দিন দ্বিতীয় দফায় জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী কাবিলউদ্দিন শেখের দাবি, ‘বিজেপি প্রার্থী তো তৃণমূলের লোক। ওরা কোনও ফ্যাক্টর নয়। আসল লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে।’

২০২১–এর ভোটে কাবিল, কংগ্রেসের টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই অভিযোগে কাবিলকে সাসপেন্ড করেছিল দল। সাসপেনশন তুলে তাঁকে প্রার্থীই করে দিয়েছে কংগ্রেস। এলাকার কংগ্রেস নেতা কাশেমের সঙ্গে কাবিলের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা আবার কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। কংগ্রেস প্রার্থী বলছেন, ব্লকের সাংগঠনিক কাজ নজরদারি করতে গিয়ে তিনি তেমন সময় দিতে পারেননি। পলাশির বাসিন্দা, নদিয়া জেলা সিপিএমের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য দেবাশিস আচার্য বলেন, ‘সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারলে জোটের প্রার্থীই জিতবে।’

মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি ছেড়েছেন আলিফা। দলের মধ্যে আলিফার প্রয়াত বাবার সঙ্গে যাঁদের দূরত্ব ছিল, দলের সেই অংশ আলিফাকে প্রকৃতই কতটা মেনে নিয়েছেন এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গিয়েছে। দলের ব্লক সভাপতি দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে লালের সুসম্পর্ক ছিল না। এই দেবব্রতই আলিফার নির্বাচনী এজেন্ট। প্রচারে প্রার্থীর সঙ্গে বেদম ছুটছেন। তাঁর দাবি ফুল বদল হবে না।