• স্বাস্থ্য সাথীর রোগীর থেকে টাকা চেয়ে ‘হুমকি’ বিধায়কের নার্সিংহোমের
    আনন্দবাজার | ১৮ জুন ২০২৫
  • মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের শুরু করা স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প ‘স্বাস্থ্য সাথী’। মূলত দরিদ্র রোগীরা যাতে নিখরচায় বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে চিকিৎসা পেতে পারেন, তার জন্য শুরু করা প্রকল্পটি যথেষ্ট চর্চিত। ভোটের প্রচারেও তৃণমূল সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসাবে সেটি তুলে ধরা হয়। অথচ, শাসকদলেরই এক ‘হেভিওয়েট’ বিধায়কের নার্সিংহোমে সেই প্রকল্পেই রোগীকে ভর্তির পরেদফায় দফায় টাকা নেওয়া এবং ডাক্তারের ফি ও অস্ত্রোপচারের টাকা না-দিলে চিকিৎসা বন্ধ করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে! আরও অভিযোগ, ওই রোগীকে দেখছিলেন বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, যিনি আদতে প্যাথলজিস্ট। সরকারিহাসপাতালে হুমকি-প্রথায় অভিযুক্ত হয়ে সাসপেন্ড হয়েছিলেন তিনি।

    উত্তর কলকাতার সিঁথির মোড়ের নিউ সরযূ নার্সিংহোমে ঘটনার সূত্রপাত। এটি শ্রীরামপুর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায়ের পারিবারিক নার্সিংহোম।তাঁর বাড়িতেই নার্সিংহোমটি চলে। যদিও এখন দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর দুই চিকিৎসক কন্যা, শিল্পা বসুরায় ও সুবেশা বসুরায়। সুদীপ্ত নিজে স্বাস্থ্য দফতরের হেলথরিক্রুটমেন্ট বোর্ডের মাথায় রয়েছেন। তিনি রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলেরও প্রধান এবং কিছু দিন আগে পর্যন্ত একাধিক মেডিক্যাল কলেজের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন।

    উল্লেখ্য, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে ইডি-র অফিসারেরা এই নার্সিংহোমে দীর্ঘদিন তল্লাশি চালিয়েছিলেন।

    ওই নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া কৃষ্ণগোপাল অধিকারী (৭৩) নামে এক দিনমজুরের পরিবার গত ১৬ জুন স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপনিগমের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে (রেজিস্ট্রেশন নম্বর— ২৫০৬০৭১৩৪২২৭১৮৯৩) গত ৬ জুন ওই নার্সিংহোমে কৃষ্ণগোপালকে ভর্তি করা হয়। তার পরে কী ভাবে বার বার তাঁদের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে এবং আরও টাকা না দিলে অস্ত্রোপচার করা হবে না ও ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে, সে কথা তাঁরা অভিযোগে জানিয়েছেন।

    অভিযোগ, প্রথমে স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে ২৫৫০ টাকা ‘ব্লক’ করা হয়। তার পরে শুরু হয় বিনা রসিদে টাকা নেওয়া। রোগীর ছেলে পরমানন্দ অধিকারীর কথায়,‘‘১৩ জুন নার্সিংহোমের ম্যানেজার শুভময় দাস জানান, ডাক্তারের ফি ও কিছু পরীক্ষা মিলিয়ে ১৭ হাজার টাকা এবং ওষুধের জন্য ১৯ হাজার টাকা দিতে হবে। আমরা অনেক কষ্টে ১২৫০০ টাকা জমা দিই। তখন শুভময় জানান, টাকা না দিলে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হবে।’’

    পরমানন্দের আরও অভিযোগ, ‘‘নার্সিংহোম থেকে আরও বলা হয়, অস্ত্রোপচারের আগে ৪০ হাজার টাকা না দিলে চিকিৎসা বন্ধ রাখা হবে। আমরা জানতে চাই, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে ভর্তি করালে কেন এত টাকা দেব? ওঁরা জানান, বাবা স্বাস্থ্য সাথীর টাকা পাবেন না! হতভম্ব হয়ে আমরা তখন সব জায়গায় লিখিত অভিযোগ করি।’’

    প্রসঙ্গত, গত ১৩ জুন নার্সিংহোমের তরফে ‘এস কে তিওয়ারি’ নামে এক চিকিৎসকের ৩০০০ টাকা ফি এবং ‘ডাক্তার বিশ্বাস’ নামে এক চিকিৎসকের ৭০০০টাকা ফি রোগীর পরিজনদের থেকে নেওয়া হয়। অভিযোগ, ওই ‘ডাক্তার বিশ্বাস’ হলেন চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস।

    কিন্তু প্যাথলজিস্ট হয়ে তিনি কী ভাবে নার্সিংহোমের আইসিইউ-এ রোগী দেখতে পারেন?বিরূপাক্ষের বক্তব্য, ‘‘এর উত্তর আমি আপনাকে বা অন্য কাউকে দিতে বাধ্য নই।’’

    দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের বাসিন্দা ওই রোগীর পরিবারের তরফে ১৬ জুন রাতে স্থানীয় কাশীপুর থানাতেও এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করতে যাওয়া হয়। পরমানন্দের অভিযোগ, বহু অনুরোধ সত্ত্বেও থানা কোনও অভিযোগ দায়ের করতে দেয়নি। গোটা বিষয়টি জানিয়ে ১৭ জুন মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে,লালবাজারে ও হেলথ রেগুলেটরি কমিশনেও অভিযোগ জমা করেছেন পরমানন্দ।

    এ ব্যাপারে নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, ‘‘অভিযোগ খতিয়ে দেখে স্বাস্থ্য সাথী সেল নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে।’’ নার্সিংহোমের ম্যানেজার শুভময়ের দাবি, ‘‘ওই রোগী স্বাস্থ্য সাথীতে ভর্তি হননি।’’ যদিও এই দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। ১৭ জুন রোগীর বাড়ির লোককে ফোন করে ১ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা জমা দিয়ে রোগীকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

    সুদীপ্ত রায়কে ফোন করা হলে তিনি কিছু বলতে চাননি। তাঁর মেয়ে সুবেশা বসুরায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘পরিকল্পনা করেফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমার বাবার সম্মানহানি করা হচ্ছে। ওই রোগী স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত নন।’’ অন্য মেয়ে শিল্পা বসুরায়ও একই রকম ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, ‘‘লিখে দিন,ওই রোগীর চিকিৎসা স্বাস্থ্য সাথীতে হয়নি। বাড়ির লোককে টাকা দিতেই হবে।’’

    স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের আওতায় ভর্তি হয়েও রোগী প্রকল্পের সুবিধা কেন পাবেন না? তার কোনও সদুত্তর অবশ্য তাঁরা দেননি।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)