• তৃণমূলের চর্চায় জয়ের ব্যবধান, বিজেপির লক্ষ্য অন্যরকম, দীর্ঘ কংগ্রেস দাপট অতীত, কালীগঞ্জে তবু ‘ভিন্ন’ প্রাপ্তির আশায় বাম
    আনন্দবাজার | ১৮ জুন ২০২৫
  • রাত পোহালেই উপনির্বাচন নদিয়ার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে। জয়-পরাজয় নিয়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের কপালে কোনও দুশ্চিন্তার ভাঁজ নেই। থাকার কথাও ছিল না। কিন্তু কালীগঞ্জ কাহিনির ‘মোচড়’ অন্যত্র। ১৯৫১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ১৬টি নির্বাচনের সামগ্রিক পরিসংখ্যানে জমানা নির্বিশেষে সবচেয়ে দাপুটে দল এবার সবচেয়ে পিছনে। বামেদের সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী মাঠে নেমেছেন বটে। কিন্তু জামানত বাঁচবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কর্মীদের একাংশেরও। তুলনায় ‘উজ্জীবিত’ বিজেপি। কালীগঞ্জে তারা কখনও জেতেনি। বলার মতো পরিসংখ্যান বলতে একবার দ্বিতীয় হওয়া। তবু উপনির্বাচনে বিজেপি ঘাম ঝরিয়েছে। কারণ, কালীগঞ্জে তাদের লক্ষ্য অন্যরকম।

    উপনির্বাচন বলে গা-ছাড়া ভাব দেখায়নি তৃণমূল। প্রার্থী ঘোষণা করেছে সকলের আগে। প্রার্থী আলিফা আহমেদকে নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ বার বার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। ঘটনাচক্রে, আলিফা কালীগঞ্জের প্রয়াত বিধায়ক নাসিরুদ্দিন আহমেদের (লাল) কন্যা। কিন্তু তাঁর মতো শিক্ষিত, কর্পোরেট আদবকায়দা জানা, ঝকঝকে মুখকে প্রার্থী হিসাবে তুলে ধরে প্রচারেও কর্মীদের সুবিধা হয়েছে। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘আমাদের প্রার্থী খুব ভাল। যোগ্য প্রার্থী। প্রার্থী বাছাইয়ের প্রশ্নে আমরা অন্য সকলে চেয়ে এগিয়ে রয়েছি।’’

    তবে তা বলে তৃণমূল আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চাইছে না। তাই প্রথম সারির মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কদের দফায় দফায় পাঠানো হয়েছে কালীগঞ্জে। ফলাফল নিয়ে কুণাল বলছেন, ‘‘কালীগঞ্জে আমাদের প্রত্যাশা জয় এবং বিপুল জয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে, এলাকা নির্বিশেষে, সর্বত্র আমাদের জয় হবে। গোটা বিধানসভা কেন্দ্রের সব এলাকার মানুষ আমাদের ভোট দেবেন। কারণ, ভোট হবে উন্নয়নের পক্ষে।’’ ব্যবধান কত হবে, সে সংখ্যাতত্ত্বে অবশ্য তিনি যেতে চান না। শুধু বলছেন, ‘‘বিপুল ব্যবধানই হবে।’’ তার কারণ ব্যাখ্যা কুণাল বলছেন, ‘‘কংগ্রেস ভোট পাবে না। কারণ, বাংলার মানুষ বুঝে গিয়েছেন, কংগ্রেস বা সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানে ঘুরিয়ে বিজেপিকে সাহায্য করা। ওখানে যাঁরা কংগ্রেসকে দীর্ঘ দিন ভোট দিতেন, তাঁরাও এবার তৃণমূলকেই দেবেন। আর পশ্চিমবঙ্গে তো তৃণমূলই আসল কংগ্রেস।’’

    তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলছেন, ‘‘উপনির্বাচনে সাধারণত ভোট কিছু কম পড়ে। সে কথা মাথায় রেখেও বলছি, আমাদের জয়ের ব্যবধান ৫০ হাজারের উপরে থাকবে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘প্রথমত, কালীগঞ্জে অন্য কোনও দলের সংগঠন নেই। সব বুথে তারা এজেন্টই বসাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, লালসাহেব অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তাঁদের গোটা পরিবারের প্রতি এলাকার মানুষের শ্রদ্ধা রয়েছে।’’

    বিজেপির তরফে উপনির্বাচন সামলাচ্ছেন রানাঘাটের সাংসদ তথা দলের অন্যতম রাজ্য সহ-সভাপতি জগন্নাথ সরকার। তিনি বলছেন, ‘‘কালীগঞ্জের হিন্দু ভোটের ৮০ শতাংশ এর আগেও আমরা পেয়েছি। এ বার সেটা ৯০ শতাংশ হবে। আর আমাদের সেই অতিরিক্ত ভোট কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের ঝুলি থেকেই আসবে।’’ তাতে কি জয় হবে? জগন্নাথ এ প্রশ্নের ঘুরিয়ে উত্তর দিচ্ছেন, ‘‘হার অনিবার্য, এমন আমরা মনে করছি না।’’

    সত্যিই মনে করছেন না? নাকি কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে এ সব বলছেন? জগন্নাথের জবাব, ‘‘তৃণমূলের প্রার্থী রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের মধ্যে একটা অংশ তাঁর বিরোধী। বিধায়কের প্রয়াণের পর তৃণমূলের অন্য অনেকে বিধায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু উপনির্বাচনে টিকিট পেয়ে গিয়েছেন তাঁর মেয়ে। তিনি জিতলে আট মাস পরের বিধানসভা ভোটেও তিনিই টিকিট পাবেন। অন্য নেতাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই ভিতরে ভিতরে বিরোধিতা চলছে।’’ বিজেপি সাংসদের আরও দাবি, ‘‘এটা সরকার গড়ার ভোট নয়। তাই তৃণমূলের একাংশ কংগ্রেসকে ভোট দিতে পারেন। তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে সেই ভাগাভাগি হলে আমরা জিতব না, এমন ভাবার কারণ নেই।’’

    কালীগঞ্জে ভোটারের সংখ্যা আড়াই লক্ষের আশেপাশে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের নাসিরুদ্দিন পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ১২ হাজারের কাছাকাছি ভোট। বিজেপির অভিজিৎ ঘোষ পেয়েছিলেন প্রায় ৬৫ হাজার। ব্যবধান যথেষ্ট। কংগ্রেসের পাওয়া ২৫ হাজার ভোট যোগ হলেও বিজেপি জিতত না। সংখ্যালঘু প্রধান কালীগঞ্জ বিজেপির জন্য বরাবরই ‘কঠিন’ আসন। তবু এই উপনির্বাচনে বিজেপি চোখে পড়ার মতো প্রচার করেছে। প্রার্থী আশিস ঘোষের সমর্থনে সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারী, দু’জনেই প্রচার করেছেন। এক ঝাঁক বিধায়ককেও ময়দানে নামানো হয়েছে ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের দায়িত্ব দিয়ে। নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে রাজ্য পুলিশকে পুরোপুরি দূরে রাখতে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে দরবার করেছে বিজেপি।

    এর পরেও ‘শোচনীয় হার’ হলে মুখ পুড়বে বিজেপির। যদিও তারা আপাতত সে সব ভাবছে না। নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় রত এক নেতার বক্তব্য, এ বার তাঁদের লড়াই ‘অন্যরকম’। তাঁর দাবি অনুযায়ী সেই অন্যরকম’ হল হিন্দু ভোট আগের চেয়েও বাড়ানো। তাঁর কথায়, ‘‘হার-জিত পরে। আপাতত যত বেশি সম্ভব হিন্দুকে একত্রিত করতে হবে।’’

    কালীগঞ্জের উপনির্বাচনে মেরুকরণের ছাপ যে পড়বে, তা কংগ্রেসও মানছে। প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী বলছেন, ‘‘সারা বাংলা জুড়েই আমরা বিভাজনের রাজনীতির শিকার হয়েছি। কালীগঞ্জও বাদ যায়নি। আমাদের ভোটারদের একটা অংশ তৃণমূলে চলে গিয়েছেন, একটা অংশ বিজেপির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন।’’ পোড়খাওয়া রাজনীতিক অধীর বলছেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা সকলেই লড়ছেন। সিপিএমও আমাদের সমর্থন করছে। কিন্তু দীর্ঘদিন আমাদের রাজনৈতিক গতিবিধি তেমন ছিল না। এখন ভোটের সময়ে আবার সকলে নেমেছে। কিন্তু সংগঠন তো দুর্বল হয়েছে। তাই জিতে যাব, কখনওই সে কথা বলছি না।’’

    কালীগঞ্জে গত ৭৪ বছরের নির্বাচনী তথ্য বলছে, ৪৪ বছর আসনটি কংগ্রেসের দখলে ছিল। বস্তুত, বাম জমানার একটা বড় সময় জুড়েও কালীগঞ্জ ছিল কংগ্রেসের। ২০ বছর আসনটি ছিল বামফ্রন্টের শরিক আরএসপির দখলে। তৃণমূল ২০১১ সালে প্রথম বার কালীগঞ্জ জেতে। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে। ২০১৬ সালে জোট ছেড়ে হেরে গিয়েছিল তৃণমূল। জিতেছিলেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী হাসানুজ্জামান শেখ। তবে ২০২১ সালে কালীগঞ্জে পুরোপুরি নিজের ক্ষমতায় জিতেছিল তৃণমূল। সেই বিধানসভা নির্বাচনের আগে কখনও বিজেপি কালীগঞ্জে ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি।

    অর্থাৎ, যে দু’টি দলের জন্য কালীগঞ্জ ছিল সবচেয়ে কঠিন, এই উপনির্বাচনে তারাই পরস্পরের প্রধান প্রতিপক্ষ। আর বরাবর যাদের ‘গড়’ ছিল কালীগঞ্জ, সেই বাম-কংগ্রেস এখন বহু পিছনে।

    সিপিএমের তরফে নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক সুমিত দে অবশ্য বলছেন, ‘‘তৃণমূল এবং বিজেপির যে দ্বিমেরু রাজনীতি তৈরি করা হয়েছে, সেটা ভেঙে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা এই ভোটে রয়েছে। তৃণমূল বা বিজেপির বাইরে কোনও বিকল্প নেই, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এই ভোটে ধাক্কা খেতে পারে। সেটা আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে টের পেয়েছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের এই ধারণা ঠিক হলে সেটাই হবে এই উপনির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)