লোকসভা নির্বাচনের পরে রাজ্যে দু’দফায় উপনির্বাচন হয়েছে ১০টি বিধানসভা কেন্দ্রে। তৃণমূল কংগ্রেসের অনুকূলে ফল ১০-০! তাদের সেই মুকুটে আরও একটি পালক সংযোজিত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা, এমনই আশা শাসক দলের। কিন্তু বছরখানেক পরের বিধানসভা নির্বাচনের সমীকরণ যখন দিগন্তে ভেসে উঠতে শুরু করেছে, তার আগের মহড়া কত দূর হয়, তার জন্য নজর রাখতে হচ্ছে কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে।
দুর্নীতি বা অপশাসন সংক্রান্ত বিবিধ অভিযোগ প্রচারে রেখেই বাংলায় একের পর এক নির্বাচন এবং উপনির্বাচন হয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের জয়ের পথে সে সব বিশেষ কাঁটা হয়নি। কিন্তু কালীগঞ্জের এই উপনির্বাচন যখন হতে চলেছে, তত দিনে হিন্দুত্বের সুরকে সপ্তমে তুলে নিয়ে গিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। শাসক তৃণমূলের পাশার দান উল্টে দেওয়ার জন্য তাদের নজর ৪-৫% বাড়তি ভোট টানার দিকে। হিন্দুত্বের ভাবাবেগে শাণ দিয়েই সে কাজে সম্ভব বলে বিশ্বাস করছেন শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারেরা। কালীগঞ্জের প্রচারে গিয়ে প্রাণপণে সেই চেষ্টাই চালিয়েছেন বিরোধী দলনেতা ও বিজেপির রাজ্য সভাপতি। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বাম ও কংগ্রেস জোটের ভূমিকা। মেরুকরণের পরিমণ্ডলেও কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী এস এম শাদি গত বছর নির্বাচনে কালীগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় ১৮%-এর বেশি ভোট পেয়েছিলেন। বিজেপি ছিল দ্বিতীয় স্থানে। পরবর্তী সব উপনির্বাচনে বাম বা কংগ্রেসের ভোটের শতাংশ দু’অঙ্ক পেরোয়নি। বাংলাদেশ বা মুর্শিদাবাদের ঘটনার পরে হিন্দুত্বের তেজীয়ান রথে সওয়ার বিজেপির নজর রয়েছে বাম-কংগ্রেসের বাক্স ভেঙে নিজেদের ঝুলিতে ভোট বাড়ানোর। আর বাম ও কংগ্রেসের লড়াই মূলত নিজেদের ঘর আগলানোর। এই অঙ্কেই কালীগঞ্জের উপনির্বাচন থেকে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ইঙ্গিত পড়ার চেষ্টা হবে।
তৃণমূলের বিধায়ক নাসিরুদ্দিন (লাল) আহমেদের মৃ়ত্যুতে নদিয়ার কালীগঞ্জে উপনির্বাচন হচ্ছে। ভোট কাল, বৃহস্পতিবার। ফল ঘোষণা হওয়ার কথা আগামী ২৩ জুন। প্রয়াত নাসিরুদ্দিনের কন্যা, বড় সংস্থার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পূর্ণ সময়ের রাজনীতিতে চলে আসা আলিফা আহমেদ এলাকায় এলাকায় জনসংযোগে ঘুরেছেন ‘বাবার অপূর্ণ কাজ’ এবং ‘দিদির আশীর্বাদে’র কথা বলেই। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ময়দানে আছেন বিজেপির আশিস ঘোষ এবং বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী কাবিলউদ্দিন আহমেদ। প্রথম দিকে জোটে কাঁটা থাকলেও অমিতাভ চক্রবর্তীর মতো প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সে কাঁটা তোলার যথাসাধ্য তোলার চেষ্টা করেছেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের সঙ্গে প্রচারে দেখা গিয়েছে সিপিএমের শাদি, অলকেশ দাস বা শতরূপ ঘোষদের। আবার মুখে উপনির্বাচনকে গুরুত্ব না-দিলেও প্রচারে গিয়েছেন বিজেপির শুভেন্দু-সুকান্তেরা।
শুভেন্দু তাঁর তাস কোনও ভাবেই গোপন রাখার চেষ্টা করেননি। কালীগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় ৫৭% সংখ্যালঘু ভোটারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘‘এমন যাঁরা মোদীজি’র রেশনের চাল নেন, কোভিডের সময় টিকা নিয়েছিলেন, আবাস যোজনার ঘর বা শৌচালয় নিয়েছেন। কিন্তু ভোট এলে বলেন, আপনারা হিন্দুদের দল। আপনাদের ভোট দেব না। আমাদের তাতে কোনও আপত্তি নেই!’’ হিন্দু ভোটই যে তাঁর পাখির চোখ, তা বুঝিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘‘আমরা কাদের ভোট পাই, সেটা আপনারা জানেন। যাঁরা আমাদের ভোট দেন, দলে দলে ভোট দেবেন।’’ বিজেপি কর্মীদের বুথ আগলানোর পরামর্শ দিয়েছেন শুভেন্দু ও সুকান্ত, দু’জনেই।
বিজেপির প্রার্থী দেবগ্রামে বিজেপি ও তৃণমূলের যৌথ পরিচালিত পঞ্চায়েতের পদে আছেন, এই অভিযোগ সামনে রেখে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর বলছেন, ‘‘বিজেপিকে ভোট দেওয়া মানে তো তৃণমূলকে ভোট দেওয়া! আর তৃণমূলকে দেওয়া মানে আরএসএসের শক্তি বাডাতে সাহায্য করা। কাবিল শেখকে উপনির্বাচনে এক বার ভোট দিয়ে দেখুন তিনি বিধানসভায় সাধারণ মানুষের কথা বলতে পারেন কি না। না পারলে ২৬-এ আবার ভোট দিয়ে ওঁকে হারিয়ে দেবেন!’’
তৃণমূলের অবশ্য দাবি, এ বারেও জয়ের ব্যবধান অন্তত ৫০ হাজার হবে। রাজ্য দলের সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের মতে, ‘‘যে বিধায়কের মৃত্যুতে উপনির্বাচন, তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। আমাদের প্রার্থী শুধু তাঁর মেয়েই নন, রাজনীতিতেও অভিজ্ঞ।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বিরোধীরা তো ইতিবাচক বিকল্পের কোনও কথা বলতে পারেনি। তাদের নেতিবাচক রাজনীতিও তৃণমূলের রাস্তা চওড়া করছে।’’