• অভিষেকের মাস্টারস্ট্রোক, প্রশ্নবাণে বদলে দিলেন খেলা, বিজেপির আকাশে সিঁদুরে মেঘ
    এই সময় | ১৭ জুন ২০২৫
  • পহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে ৫৫ দিনেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। এই হামলার জবাবে ভারত সরকার ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করেছে। পাকিস্তানে অবস্থিত জঙ্গি ঘাঁটিগুলি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি সেনাঘাঁটিতেও। কিন্তু, এখনও এই হামলা নিয়ে বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন থেকে গিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে, যার কোনও জবাব দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত সুরক্ষা, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়ে সোমবার সোশ্যাল মিডিয়ায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিদ্ধ করেছেন মোদী সরকারকে।

    কী কী প্রশ্ন তুলেছেন অভিষেক?

    অভিষেক বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে মূলধারার মিডিয়া, বিরোধী দলের সদস্যরা বা বিচার বিভাগ কেউই ভারত সরকারের সামনে এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করতে এগিয়ে আসেনি, এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘দেশ স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ফলাফলের দাবি রাখে --- নীরবতা এবং কথার খেলা নয়!’

    সীমান্ত লঙ্ঘন এবং অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা

    এখনও পর্যন্ত পহেলগাম হামলার পিছনে গোয়েন্দা ব্যর্থতার দায় কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নেয়নি। চার জন সন্ত্রাসবাদী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কী ভাবে ভারতের সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করল এবং পহেলগামে বিনা বাধায় এই হত্যাযজ্ঞ চালাল, সেটাই তৃণমূল সাংসদের প্রথম প্রশ্ন।

    তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এত বড় মাপের জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের দায় কে নেবে?’

    গোয়েন্দা ব্যর্থতা, আইবি প্রধানের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং পেগ্যাসাস

    অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় প্রশ্ন, গোয়েন্দা ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো প্রধানের মেয়াদ কেন এক বছর বাড়ানো হলো? এই মেয়াদ বৃদ্ধির সময় এবং এর পিছনে কী যুক্তি রয়েছে, জানতে চেয়েছেন তিনি।

    তাঁর প্রশ্ন, পহেলগাম হামলা যদি গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণে হয়ে থাকে, তা হলে আইবি প্রধানের জবাবদিহি চাওয়ার পরিবর্তে কেন তাঁকে পুরস্কৃত করা হলো? এর পিছনে সরকারের কী বাধ্যবাধকতা ছিল, প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

    এই প্রসঙ্গে ‘পেগ্যাসাস’-এর মতো নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়েও সরকারের সমালোচনা করেছেন ডায়মণ্ড হারবারের সাংসদ।

    তিনি লিখেছেন, ‘যদি ভারত সরকার বিরোধী নেতাদের (আমি-সহ), সাংবাদিক এবং এমনকী বিচারকদের বিরুদ্ধেও পেগ্যাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করতে পারে, তা হলে সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে একই সরঞ্জাম ব্যবহার করতে তাদের বাধা কোথায়?’

    সেই সন্ত্রাসবাদীরা এখন কোথায়?

    অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানে অবস্থিত জঙ্গি ঘাঁটিগুলি গুঁড়িয়ে দিলেও, এই হামলার পিছনে চিহ্নিত চার সন্ত্রাসবাদীকে নিয়ে এখনও নীরব মোদী সরকার? অভিষেক প্রশ্ন তুলেছেন, এই চার সন্ত্রাসবাদী মৃত না জীবিত?

    তিনি লিখেছেন, ‘যদি তাদের নির্মূল করা হয়ে থাকে, তা হলে সরকার কেন স্পষ্ট বিবৃতি দিতে পারছে না? আর যদি তা না হয়ে থাকে, তা হলে চুপ করে আছে কেন?’

    পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং সংঘর্ষ বিরতির জন্য সমঝোতা

    পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর ঘিরে যে বিতর্ক, তা-ও খুঁচিয়ে তুলেছেন অভিষেক। ভারত কখন পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ।

    ভারত-পাক সংঘর্ষ বিরতির পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেছিলেন, বাণিজ্য বন্ধের চাপ দিয়ে ভারতকে সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি করিয়েছে ওয়াশিংটন। ভারত সরকার কেন সরকারি ভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বিবৃতির কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।

    তৃণমূল সাংসদের মতে, সংকটের সময়ে দেশ ঐক্যবদ্ধ ভাবে থেকেছে। সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্বকে অভিবাদন জানিয়েছে। কিন্তু মোদী সরকার ১৪০ কোটি ভারতীয়ের আবেগকে উপেক্ষা করেছে। অভিষেকের প্রশ্ন, কীসের জন্য সরকারকে এই আপসের রাস্তায় হাঁটতে হলো?

    কূটনৈতিক ব্যর্থতা

    অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ প্রশ্নটি বিজেপি সরকারের পক্ষে আরও অস্বস্তিকর। বিভিন্ন সময়ে মোদী সরকারের আমলে ভারত ‘বিশ্বগুরু’তে পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেছেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা। কূটনীতিকে মোদী সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে দাবি করা হয়। গেরুয়া শিবিরের দীর্ঘদিনের এই দাবিকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

    তিনি জানিয়েছেন, পহেলগাম হামলার পরে ৩৩টি দেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের পাঠিয়েছিল সরকার। তিনি নিজেও এমন একটি দলের অংশ ছিলেন। কিন্তু, কতগুলি দেশ ভারতকে স্পষ্ট ভাবে সমর্থন করেছে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অভিষেক।

    অন্য দিকে পহেলগাম হামলার পরপরই আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের কাছ থেকে বড় অঙ্কের আর্থিক সাহায্যের অনুমোদন আদায় করেছে পাকিস্তান। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাদের যোগ নিয়ে কোনও আন্তর্জাতিক স্তরে কোনও তদন্তও হয়নি। এমনকী পাকিস্তানকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসবাদ দমন কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে।

    অথচ, গত ১০ বছরে বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নয়নে দুই লক্ষ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এতে লাভ কী হয়েছে, প্রশ্ন তুলেছেন অভিষেক।

    অভিষেকের মাস্টারস্ট্রোক

    তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের এই সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, বিভিন্ন দিক থেকে মাস্টারস্ট্রোক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।

    প্রথমত, তাঁর টাইমিং। অর্থাৎ, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি তোলার সময়। পহেলগাম হামলার পরে ৫৫ দিন কেটে গিয়েছে। হামলার পরপরই যদি এই প্রশ্নগুলি তোলা হলে তা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতো। সেই সময়টা ছিল ঐক্যবদ্ধ থাকার।

    তখন অভিষেক এই প্রশ্নগুলি তোলেননি। বরং কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে, কেন্দ্রের দূত হয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন এই হামলা সম্পর্কে দেশগুলিতে অবহিত করতে। অপেক্ষা করেছেন সঠিক সময়ের।

    দ্বিতীয়ত, অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যে অনেকটাই পিছনে চলে গিয়েছে পহেলগাম হামলার পিছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ দিনের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে আবার পহেলগাম হামলা কেন ঠেকাতে পারল না ভারত, সেই প্রশ্নটা সামনে চলে এল।

    তৃতীয়ত, বিজেপি বর্তমানে অপারেশন সিঁদুরের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। সামনেই বিহারের নির্বাচন। সেখানে সভা করতে গিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পাকিস্তান ভুলে গিয়েছে এখানে মোদী বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে’।

    রাজনৈতিক বিশ্লেযকদের একাংশের ব্যাখ্যা, এর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে যে ভাবে বালাকোট এয়ারস্ট্রাইককে রাজনৈতিক আখ্যান তৈরির কাজে লাগিয়েছিল, এই ক্ষেত্রেও সেই একই প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক হয়েছিল পুলওয়ামায় সিআরপিএফ-এর কনভয়ে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে। নিহত হন ৪৬ জন সিআরপিএফ কর্মী।

    সেই সময়েও, কী ভাবে ওই হামলা হলো, কেন উড়ানে না পাঠিয়ে সিআরপিএফ কর্মীদের সড়কপথে যাত্রার ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছিল --- এই প্রশ্নগুলিকে বিজেপি পিছনে ফেলে দিয়েছিল বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের সাফল্য দিয়ে।

    এ বারেও গেরুয়া শিবির ফোকাস রাখার চেষ্টা করছে অপারেশন সিঁদুরের উপরে। এই আখ্যান তুলে ধরতে বিরোধী নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন দেশে।

    তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণে এই একচেটিয়া রাজনৈতিক আখ্যান তৈরির চেষ্টার মূলে আঘাত করলেন অভিষেক।

    চতুর্থত, বিরোধী শিবির থেকে সরকারকে কোনও প্রশ্ন করা হলেই চেনা ছকে সেই প্রশ্নকে দমিয়ে দেয় গেরুয়া শিবির। ছকটা হলো সরকারকে প্রশ্ন করলেও, বিরোধী নেতাদের দেশবিরোধী, সেনাবিরোধী ইত্যাদি তকমা দিয়ে দেওয়া।

    সম্প্রতি, পহেলগাম হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতা ও সংঘর্ষ বিরতি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবির কোনও জবাব না দেওয়া নিয়ে মোদী সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও। ‘নরেন্দর সারেন্ডার’ বলে স্লোগানও তৈরি করেছিলেন তিনি। গেরুয়া শিবিরের প্রতিক্রিয়া, তিনি পাকিস্তানের ভাষায় কথা বলছেন।

    অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই চেনা ছক কিন্তু কাজ করবে না। কারণ তিনি নিজেই সর্বভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে জাপান, ইন্দোনেশিয়া-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গিয়ে পহেলগাম হামলা এবং অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা হিসেবে পাকিস্তানের স্বরূপ উন্মোচন করে এসেছেন।

    কাজেই তাঁর গায়ে দেশবিরোধী বা সেনাবিরোধীর মতো তকমা এঁটে দেওয়া যাবে না।

    পঞ্চমত, বিদেশনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা --- মোদী সরকারের সাফল্য হিসেবে এই দুটি বিষয়কেই জোরালো ভাবে তুলে ধরে বিজেপি। এ দিন কিন্তু গেরুয়া শিবিরের এই দুই মূল বিষয়কেই প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করালেন অভিষেক। মোদী সরকারকে ‘দায়মুক্তির সরকার’ হিসেবে তুলে ধরলেন।

    বল আপাতত চলে গেল বিজেপির কোর্টে। কাশ্মীর নিয়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ের এক নতুন অধ্যায় তৈরি হলো। এ বার তারা কী জবাব দেয়, কী ভাবে এই রাজনৈতিক আক্রমণের মোকাবিলা করে, সেটাই দেখার। কেন্দ্র জবাব দিক বা নীরব থাকুক, পরিস্থিতি কিন্তু বদলে গেল।
  • Link to this news (এই সময়)