কলেজে ভর্তি, চাকরির নিয়োগে কি বাধা হবে ওবিসি মামলায় হাই কোর্টের নির্দেশ? মঙ্গলবার আবার স্পষ্ট করে দিল আদালত
আনন্দবাজার | ১৭ জুন ২০২৫
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) শংসাপত্র বাতিল মামলায় মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী রায় ঘোষণা করেছে কলকাতা হাই কোর্ট। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বেঞ্চের নির্দেশ, ওবিসি সংক্রান্ত নতুন বিজ্ঞপ্তিতে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেওয়া হচ্ছে। আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত এই নির্দেশ বহাল থাকবে। প্রশ্ন, এই নির্দেশে কি কলেজ পড়ুয়াদের ভর্তি কিংবা চাকরিতে নিয়োগে কোনও প্রভাব পড়বে? জবাব, না। বস্তুত, আদালত আগেও একাধিক বার স্পষ্ট করেছে যে, এমন কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই।
এর আগে আদালত অবমাননা সংক্রান্ত একটি মামলায় মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ হাজিরা দিয়েছিলেন হাই কোর্টে। সেই সময় আদালত জানায়, রাজ্য ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ৬৬টি সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কোনও আপত্তির কথা জানানো হয়নি। সম্প্রতি জয়েন্ট এন্ট্রান্স (মেডিক্যাল-স্নাতকোত্তর) পরীক্ষায় অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের নতুন প্যানেল তৈরি করতে বলে হাই কোর্ট। ওই মামলায় বিচারপতি কৌশিক চন্দ নির্দেশ দেন, স্নাতকোত্তর স্তরের ওই পরীক্ষায় ওবিসিদের নতুন প্যানেল তৈরি করতে হবে। কারণ, আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ২০১০ সালের পরের কোনও ওবিসি শংসাপত্র কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। গত সোমবারও একই কথা বলেছেন বিচারপতি মান্থা।
২০১০ সালের আগে মোট ৬৬টি জনগোষ্ঠীকে ওবিসি বলে ঘোষণা করা হয়। অমুসলিম জনগোষ্ঠী ছিল ৫৪টি এবং মুসলিম ১২টি। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে যাদের ওবিসি-তে নথিভুক্ত করা হয়েছে, তাদের শংসাপত্র বাতিল হয়েছে। তাই ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত যে ৬৬টি জনগোষ্ঠী অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অংশ ছিল তাদের শংসাপত্র গ্রাহ্য হবে চাকরির নিয়োগ কিংবা কলেজে ভর্তিতে। ২০২৪ সালের রায়েও তা স্পষ্ট করা হয়। মঙ্গলবারের শুনানিতে রাজ্যের বক্তব্য ছিল,এই মামলার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে কাজের সমস্যা হচ্ছে। তার আগে সোমবার বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার এজলাসে রাজ্য তাদের বক্তব্য জানায়। তাতে বলা হয়, ওবিসি মামলার জন্য কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়া, সব আটকে রয়েছে। কিন্তু আদালত জানায়, এমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট মামলার শুনানিতে আদালতের পর্যবেক্ষণ, গত ১৫ বছর ধরে ওবিসি-র সুবিধা দিয়ে এসেছে রাজ্য। কিন্তু আইন অনুযায়ী ১০ বছর অন্তর যে সমীক্ষা করতে হয়, তা করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে পূর্বতন বাম সরকার ৪২টি জনগোষ্ঠীকে ওবিসি বলে চিহ্নিত করে। তাদের মধ্যে ছিল ৪১টি মুসলিম এবং একটি অমুসলিম সম্প্রদায়। এর পর ২০১২ সালে তৃণমূল সরকার ৩৫টি জনগোষ্ঠীকে ওবিসি বলে চিহ্নিত করে। তাদের মধ্যে ৩৪টি মুসলিম এবং একটি অমুসলিম সম্প্রদায়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, বাম এবং তৃণমূল সরকারের আমলে যে ৭৭টি জনগোষ্ঠীকে ওবিসি-র তালিকায় ঢোকানো হয়, শুধুমাত্র তাদের বাতিল করা হয়েছে।
মঙ্গলের শুনানি এবং রায়
মঙ্গলবার ওবিসি শংসাপত্র বাতিল মামলায় কেন্দ্রের তরফে সওয়াল করেন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল অশোককুমার চক্রবর্তী। তিনি জানান, এর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে চেয়ারম্যান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী এনসিবিসি-র সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে ওবিসি কারা, তা নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি সওয়ালে বলেন, ‘‘ওই বৈঠকে উঠে এসেছে, ওবিসি নিয়ে দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। যার ফলে ‘ডেঞ্জারাস ডেমোগ্রাফিক এফেক্ট’ পড়বে। রাজ্য অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়নি।’’ এর পাল্টা রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) কিশোর দত্ত বলেন, ‘‘ওই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। সেখানে পুরো বিষয়টি বলা হয়েছে। সমীক্ষার কথাও জানানো হয়েছে।’’ তখনই রাজ্যের উদ্দেশে বিচারপতি মান্থার প্রশ্ন, ‘‘সমীক্ষার বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে বলেছেন কি?’’ জবাবে এজি জানান, রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে। সেখানে তালিকা জমা দেওয়া হবে। শীর্ষ আদালতে কী হয়, তার জন্য অপেক্ষা করা উচিত। এর পর তিনি বলেন, ‘‘আমাদের (রাজ্য) বিরুদ্ধে অভিযোগ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কোনও কোনও সম্প্রদায়কে সুযোগ করে দিচ্ছি আমরা।’’ এ ছাড়া মামলাকারীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার প্রেক্ষিতে দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলে, মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রায় আগেই দিয়েছে আদালত। বিচারপতি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা ৬৬টি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কিছু বলিনি। তাদের নিয়ে প্রক্রিয়া চালিয়ে নিয়ে যান। আমরা কোনও নির্দেশ দিতে চাইনি। সুপ্রিম কোর্টে মামলা রয়েছে। আপনারা পদক্ষেপ করার জন্য আমাদের মামলা শুনতে হচ্ছে।’’ রাজ্য জানায়, বিধানসভায় পেশ করা হয়েছে ওই বিষয়টি। মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ
গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, আদালতের নির্দেশে ওবিসি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকা তৈরির দায়িত্বে ছিল অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন। এ ক্ষেত্রে যে সরকারের ভূমিকা সীমিত ছিল, তা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগে বিধানসভার বক্তৃতাতেও ওবিসি তালিকা নিয়ে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ১৪০টি জনগোষ্ঠীর যে তালিকা তৈরি হয়েছে, সেখানে অমুসলিম জনগোষ্ঠীও রয়েছে। ওই তালিকার মধ্যে ৮০টি সংখ্যালঘু (মুসলিম) জনগোষ্ঠী এবং বাকি ৬০টি অমুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানান, নতুন তালিকা নিয়ে মুসলিমদের একাংশের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে। কারণ, সমীক্ষার সময়ে যাঁরা ‘ওবিসি-এ’ তালিকাভুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকে ‘ওবিসি-বি’ তালিকাভুক্ত হয়ে গিয়েছেন। আবার অনেকে ‘ওবিসি-বি’ তালিকা থেকে ‘ওবিসি-এ’ তালিকায় চলে এসেছেন।
হাই কোর্টের আগের নির্দেশ
২০২৪ সালের ২২ মে কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্যের প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করে দিয়েছিল। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছিল, ২০১০ সালের পরে অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠীদের সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করতে হবে। ওই সব শংসাপত্র ভবিষ্যতে কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। হাই কোর্টের সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। তবে হাই কোর্টের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়নি শীর্ষ আদালত। রাজ্য ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর। সেখানে রাজ্যের মামলাটি এখনও বিচারাধীন রয়েছে। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে কারও সংরক্ষণ পাওয়া উচিত নয়।
অতঃপর
বিজেপির অভিযোগ, গত ১০ জুন বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওবিসি তালিকা নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান জানিয়ে বিবৃতি দেন। প্রমাণস্বরূপ কমিশনের নোটিফিকেশন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অধিবেশনে উপস্থিত থাকলেও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে মতামত পেশের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই গত ১১ জুন বিধানসভার সচিবকে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। মঙ্গলবার রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর জানায়, ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না তাদের পোর্টালে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘‘ওবিসি নিয়ে যদি ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হয়, তখন আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু ভর্তি তো বন্ধ রাখা যায় না!’’