সঞ্জয় দে
উর্দিধারী যুবক, টানটান পেটাই চেহারা। তার উপরে দাবি ছিল, তিনি নাকি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ডানহাত। প্রথম ‘ডেট’-এ পাত্র এসেছিলেন নীলবাতি লাগানো গাড়িতে। আর ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে এই ধরনের সুপাত্র দেখে মনেও ধরেছিল দুর্গাপুরের সিটিসেন্টার অঞ্চলের বাসিন্দা তপতি দাসের (নাম পরিবর্তিত)। বাবা-মায়ের খুব একটা মত না থাকলেও জোর করেই বিয়ে করেছিলেন ‘র’ অফিসার বলে পরিচয় দেওয়া ‘এলিজিবল ব্যাচেলার’ অভিষেক মুখোপাধ্যায়কে।
কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ‘ব্যস্ত’ অভিষেক কেমন যেন ঘরকুনো হয়ে পড়েছিলেন। ‘দেশ-দশের কাজ’ ফেলে সারাক্ষণ ঘরেই বসে থাকতেন। এমনকী, তপতির থেকে ঘন ঘন টাকাও চাইতেন। সন্দেহ হওয়ায় পুলিশের দ্বারস্থ হয় তপতির পরিবার। তদন্তে ফাঁস হয়েছে অভিষেকের আসল পরিচয়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘র’ অফিসার পরিচয় দেওয়া এই যুবক আসলে হুগলির ভদ্রেশ্বরের বাসিন্দা। চাকরি নিয়েও সম্পূর্ণ ভুয়ো তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টা পরিষ্কার হতেই গ্রেপ্তার করা হয় অভিষেককে। সোমবার তাঁকে দুর্গাপুর মহকুমা আদালতে পেশ করা হলে, বিচারক তিন দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।
পাত্রের খোঁজে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে প্রোফাইল খুলেছিলেন তপতি। তা থেকেই এই ঘটনার সূত্রপাত। ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটেই অভিষেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তপতির। এর পরে ‘র’ অফিসার অভিষেক মুখোপাধ্যায়কে তাঁদের সিটিসেন্টারের বাড়িতেও নিয়ে এসেছিলেন তপতি। পরিবারের সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে আপত্তির প্রশ্নই ছিল না। অভিষেকের নীলবাতি লাগানো গাড়িতে চলাফেরা করা দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল তপতির বাড়ির লোকজনের। এমন এক পাত্র যে তাঁদের বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন, তাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছিল তাঁদের। মেয়ের পছন্দের প্রশংসা করেছিলেন তপতির বাবা-মা।
অভিষেকের এই ঠাঁটবাট পুরোটাই যে সাজানো, বিয়ের আগে তা বিন্দুমাত্রও টের পাননি তপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তবে তপতির বাবা-মায়ের একটু সন্দেহ হয়েছিল। বিয়ের আগে অভিষেকের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু নানা ছলে তা এড়িয়ে যায় অভিষেক। বস্তুত বাড়ির কথা উঠলেই সে বিভিন্ন ভাবে প্রসঙ্গ বদলে দিত। ক্রমে তাঁরা বুঝতে পারেন, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
মেয়েকে বুঝিয়ে এই সম্পর্ক থেকে বের করে আনারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তপতি তখন নকল ‘র’ অফিসারের প্রেমে মগ্ন। অভিষেককে বিয়ে করে সংসার করার স্বপ্নে বিভোর। তাই মা-বাবার আপত্তি উড়িয়েই চলতি বছরের মে মাসের গোড়ায় অভিষেকের সঙ্গে দিল্লিতে যান তপতি। সেখানে গিয়ে তাঁরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, বিয়ের নথিটিও অভিষেকের অন্যান্য নথির মতোই জাল ছিল। তাঁদের মেয়ে এক প্রতারকের পাল্লায় পড়েছে বুঝে শেষ পর্যন্ত পুলিশের দ্বারস্থ হন তাঁরা। সিটিসেন্টার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে জামাইয়ের পরিচয় যাচাই করার আবেদন করেছিলেন তাঁরা। তপতি ও অভিষেককে ফাঁড়িতে তলব করা হয়। এক আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক। টানা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অভিষেক স্বীকার করেন, ভুয়ো পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি।
এমনকী, তপতির কাছ থেকে ১ লক্ষের বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। একজন প্রতারককে বিয়ে করেছেন বুঝতে পেরে অভিষেকের বিরুদ্ধে ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ করেন তপতি। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় অভিষেককে।
সিটিসেন্টার ফাঁড়ির আধিকারিক সুদীপ্ত বিশ্বাস বলেছেন, ‘ধৃত অভিষেকের থেকে ‘র’-এর নকল স্ট্যাম্প এবং বেশ কিছু কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছে। তাঁকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করা হবে।’