• বাংলায় কথা বললে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দেশছাড়া করা হচ্ছে! মহারাষ্ট্রের ঘটনা টেনে বিজেপির বিরুদ্ধে বিধানসভায় সরব মমতা
    আনন্দবাজার | ১৬ জুন ২০২৫
  • বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে! মহারাষ্ট্রের ঘটনা টেনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিজেপিকে দুষলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার অভিযোগ, শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য তাঁদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

    সোমবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বাংলা ভাষায় কথা বললে বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লজ্জা করে না আপনাদের! আধার কার্ড, প্যান কার্ড এবং অন্য পরিচয়পত্র থাকার পরেও শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার এই কাজ করেছে। আমি তাদের ধিক্কার জানাই।” যে সব জায়গায় বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার রয়েছে, সেখানেই এই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ মমতার।

    বস্তুত, মহারাষ্ট্রে কাজ করতে যাওয়া তিন পরিযায়ী শ্রমিককে সম্প্রতি বাংলাদেশি সন্দেহে মুম্বই পুলিশ আটক করে। তাঁদের পাকড়াও করে বাংলার প্রশাসনকে না জানিয়েই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের নজরে আসে। রাজ্য প্রশাসনের উদ্যোগে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তরফে ফ্ল্যাগ মিটিং করে ওই তিন জনকে আবার ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়। রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম রবিবারই এই ঘটনার কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান। এর পরে সোমবার বিধানসভার অধিবেশনে বক্তৃতার সময় মহারাষ্ট্রের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন মমতা।

    ঘটনাচক্রে, গত কয়েক মাস ধরেই ভুয়ো নথিতে ভারতে থাকা অবৈধবাসীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে মহারাষ্ট্র, দিল্লি, অসম-সহ বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে। সম্প্রতি অসম সরকারের ‘পুশ ব্যাক’ ( অবৈধবাসীদের ধরে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো) নীতি ঘিরে আলোচনা এবং সমালোচনাও হয়েছে যথেষ্ট। এরই মধ্যে রবিবার মহারাষ্ট্রের ওই ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসে।

    ওই তিন পরিযায়ী শ্রমিক আসলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বলে দাবি করা হচ্ছে। সামিরুল সমাজমাধ্যমে জানান, যে তিন জনকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গেরই বাসিন্দা। দু’জনের বাড়ি মুর্শিদাবাদে এবং এক জনের পূর্ব বর্ধমানে। সামিরুলের বক্তব্য, ১০ জুন রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের নজরে বিষয়টি আসে। তার পরেই মুম্বই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই তিন জনের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরেও রাজ্য সরকার, পুলিশ বা পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদকে না জানিয়েই তাঁদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ সামিরুলের।

    রাজ্যকে বঞ্চনা ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’!

    বিভিন্ন প্রকল্পে রাজ্যকে বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে ফের বিধানসভায় সরব হলেন মমতা। তিনি বলেন, “গত চার বছরে ১০০ দিনের কাজের টাকা আমাদের দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বন্ধ করা অপরাধ। আমাদের টাকা অন্য রাজ্যকে দেওয়া হয়েছে, যা অপরাধ। কিছু অভিযোগ থাকতেই পারে। ১৫৫-১৫৬টি টিম (কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল) এসেছিল। তারা যা জানতে চেয়েছিল, ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু কোনও টাকা দেওয়া হয়নি।” মমতার বক্তব্য, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনও কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল বা কমিশন পাঠানো হয় না। তিনি বলেন, “কাজ করালে টাকা দিতে হবে। এটা দস্তুর। আমাদের টিম দেখা করতে গিয়েছিল। তাদের সময় দিয়েও দেখা করেনি। উল্টে কেস করে দিয়েছে। কেন্দ্র টাকা দেয়নি, বাংলা টাকা দিয়েছে। ওঁরা আমাদের টাকা দেবেন না। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।” গত চার বছরে গ্রামীণ রাস্তা এবং আবাস প্রকল্পেও রাজ্যকে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ মমতার।

    বালুরঘাটের বিজেপি বিধায়ক তথা অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ী রাজ‍্যকে আর্থিক বঞ্চনা প্রসঙ্গে তথ‍্য জানাতে চেয়েছিলেন । ওই সময় মমতা বলেন, “আশা করি অর্থনীতি আপনি আমাদের থেকে ভাল বোঝেন। কিন্তু যে প্রশ্নটা আপনি করলেন, এটা আপনি বাজেটে বলতে পারতেন। আমার অর্থমন্ত্রী উত্তর দিতে পারতেন। এটা বাজেট এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সঙ্গে আলোচনার কোনও যোগ নেই।” বাংলার জন্য বরাদ্দ টাকাকে কেন অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে, তা নিয়েও অশোককে প্রশ্ন করেন মমতা। তিনি বলেন, “বাংলাকে নিয়ে বঞ্চনার খেলা খেলবেন না। আমাদের প্রাপ্য আমরা পাই না, পাই না, পাই না।”

    বিধানসভায় ‘পথশ্রী’র খতিয়ান

    গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ এবং সংস্কারের খতিয়ান বিধানসভায় তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা তৈরি হয়েছিল। ২০১৪ সালের পর থেকে কেন্দ্র টাকা বন্ধ করে দেয়। সেই কারণে রাজ্য সরকার ‘পথশ্রী’ প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ৩৯ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করেছি। আরও ১৫০০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ রাজ্য সরকারের হাতে রয়েছে। গ্রামীণ আবাস, গ্রামীণ রাস্তা ও একশো দিনের কাজে বাংলা পর পর পাঁচ বছর দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে বলেও জানান তিনি।

    ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে মমতা

    রাজ্যে অন্য অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ও উঠে আসে বিধানসভার আলোচনায়। মুখ্যমন্ত্রী জানান, বাংলায় ৩০ শতাংশের বেশি মুসলিম রয়েছেন। ভারতের মধ্যে শতাংশের হিসাবে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, “এটা আমরা করিনি। দেশভাগের পরে এই সংখ্যা। দেশ যখন ভাগ হয়, আমরা তখন জন্মাইনি। কাজেই আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।” মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সংখ্যালঘুদের আমরা খেতে দেব না, পড়তে দেব না, শিক্ষা দেব না, মানুষ গড়ে তুলব না, এটা ঠিক নয়। তাই তাদের জন্যও ওবিসি। ওবিসি শুধু মুসলিমরা নয়।” বিধানসভায় মমতা জানান, মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনেই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর ১৪০টি জনজাতির তালিকা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে ৮০টি সংখ্যালঘু (মুসলিম) জনজাতি এবং বাকি ৬০টি অমুসলিম জনজাতি।

    মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, নতুন এই ব্যবস্থা নিয়ে মুসলিমদের একাংশের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে। কারণ সমীক্ষার সময়ে যাঁরা ওবিসি-এ তালিকাভুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকে ওবিসি-বি তালিকাভুক্ত হয়ে গিয়েছেন। আবার অনেকে ওবিসি-বি তালিকা থেকে ওবিসি-এ তালিকায় চলে এসেছেন। এই নিয়ে কারও কারও মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে বলেও জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে সাহায্য দিত, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে ২ কোটি ৫৪ লক্ষ ঐক‍্যশ্রী দেওয়া হয়েছে। ওবিসিদের জন্য ‘মেধাশ্রী’র আওতায় রাজ্য সরকারের বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে, তা-ও বিধানসভায় জানান মমতা।

    সুকান্তকে নিশানা মমতার

    সম্প্রতি কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তা নিয়েও সোমবার বিধানসভায় সরব হন মমতা। তিনি বলেন, “কোনও পয়েন্ট থাকে না বলে একতরফা ভাবে ওরা তৃণমূল এবং সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। বিভিন্ন অশ্লীল স্লোগান দেয়। চার-পাঁচ দিন আগে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওদের এক জন হাফ মিনিস্টার, যিনি মণিপুরে যেতে পারেন না, তিনি আমার পাড়ার মোড়ে ঢুকে এক জন পঞ্জাবি পুলিশ অফিসারের মাথার উপরে জুতো ছুড়েছিলেন। পঞ্জাবিরা এ নিয়ে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ এবং প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কেন ভুলে যাচ্ছেন, আমার বাড়িতে আপনি যেতে পারলে, আপনার বাড়িতেও আমি যেতে পারি।” জুতো ছোড়ার প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “এত যদি হাওয়াই চটি ভালবাসেন, প্লিজ় একটা হাওয়াই চটির দোকান খুলুন।”

    বিজেপি ‘শূন্য’ হয়ে যাবে!

    বিধানসভায় মমতা আরও বলেন, “আপনি (বিজেপি নেতারা) যদি আমাদের যে কোনও লোককে সারা ক্ষণ চোর বলে ডাকেন, আপনারা হলেন ডাকাতদের সর্দার।” এ কথা বলেই শব্দবন্ধটি ফিরিয়ে নিয়ে মমতা বলেন, “ডাকাতদের গদ্দার”। মমতা এ-ও স্মরণ করিয়ে দেন, তিনি নিজেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। বিজেপি সরকারে আসার পরে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি, তা-ও মনে করিয়ে দেন মমতা। বিজেপি বিধায়কদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ২০২৬ সালে বিজেপি ‘শূন্য’ হয়ে যাবে।

    ২১ জুলাইয়ের পোস্টার বিলি

    বিধানসভায় বিধায়কদের হাতে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের প্রচারের জন‍্য একটি করে পেন ড্রাইভ তুলে দেওয়া হয়েছে শাসকদলের তরফে। সেটিতে রয়েছে হোর্ডিং, ব্যানার এবং পোস্টারের ছবি। সেগুলিতে থাকছে শুধুমাত্র দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার ছবি।

    সাসপেন্ড বিজেপি বিধায়ক

    অধিবেশনে গোলমাল পাকানো এবং স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে কুমারগ্রামের বিজেপি বিধায়ক মনোজ ওঁরাওকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের আসন ছেড়ে উঠে বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতককে সতর্ক করে দেন স্পিকার। বিধায়ককে নিলম্বিত করার প্রতিবাদে বিজেপি বিধায়কেরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন এবং শেষে অধিবেশনকক্ষ ত্যাগ করেন তাঁরা।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)