• ভাঁড়ে মা ভবানী, গাড়ির তেলের জন্যও টাকা নেই
    এই সময় | ১৬ জুন ২০২৫
  • ভিড়ে ঠাসা আদালত চত্বর। মেন গেট থেকে আদালত পর্যন্ত এলাকায় বহু মানুষ দাঁড়িয়ে। আচমকাই, এক পুলিশকর্মী খানিকটা হন্তদন্ত হয়ে সেই ভিড় সরাতে শুরু করলেন, ‘সরে যান, সরে যান। স্যর আসছেন।’ এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই।

    কিন্তু, ঘাড় ঘুরিয়ে পরের দৃশ্য দেখে হতবাক সেই ভিড়। দেখা যায়, এক বেশ রাশভারি ব্যক্তি হাতে-টানা রিক্সায় বসে আদালত চত্বরে ঢুকছেন। আর সেই রিক্সাকে সামনে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছেন ওই পুলিশকর্মী।

    কে এই ভিআইপি, যিনি রিক্সায় চেপে আদালতে ঢুকছেন? যদি ভিআইপি–ই হবেন, তা হলে রিক্সায় কেন? তাঁর বাতি লাগানো গাড়ি কোথায়?

    খোঁজ নিতে গিয়ে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর এক তথ্য। রিক্সায় আসা ওই ব্যক্তি আদতে ওই আদালতেরই বিচারক। আদালত থেকে কিছুটা দূরে তাঁর কোয়ার্টার। সে দিন গাড়ি না–পেয়ে রিক্সায় এসেছেন।

    কেন পেলেন না গাড়ি? জানা গিয়েছে, যে ব্যক্তি বিচারককে গাড়ি ভাড়া দেন, সরকারের ঘরে তাঁর লক্ষ লক্ষ টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। তিনিও আর টানতে পারছেন না। পকেট থেকে আর কত জ্বালানির টাকা দেবেন?

    সাম্প্রতিক অতীতে দক্ষিণবঙ্গের এক জেলা আদালতের ওই ঘটনা অবশ্য সরকারি ভাবে স্বীকার করেনি বিচার বিভাগ। শুধু প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে ওই দৃশ্যের কথা জানা গিয়েছে। কিছুদিন আগে নাকি একই কারণে দুর্গাপুরে বিচারকেরা দল বেধে হেঁটে আদালতে যান। সেই বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছে।

    এতদিন বিচারকেরা মূলত ভাড়া গাড়ি ব্যবহার করছিলেন। জেলার কোনও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সেই গাড়ি নেওয়া হতো। সেই ব্যবসায়ীই গাড়ির চালক ও জ্বালানির টাকা খরচ করতেন। বিল করে সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিতেন।

    অভিযোগ, গত বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমশ বকেয়া জমছে। তা বাড়তে বাড়তে এখন পাহাড়-সমান। সূত্রের খবর, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আদালতে ভাড়া গাড়ির টাকা ২০২২ থেকে বকেয়া। পরিমানটা প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা।

    হুগলি জেলাতে গাড়ির বিল বাবদ ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা বাকি। কোনও জেলায় বকেয়া ১০ লক্ষ টাকায় পৌঁছনোর পরে ডেকে কখনও এক–দুই লক্ষ টাকা দেওয়াও হচ্ছে। বাকিটা আবার বকেয়া পড়ে থাকছে।

    জানা গিয়েছে, রাজ্যের প্রায় ১৪০০ জেলা বিচারকদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই এখন নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করছেন। বলা হয়েছে, জুন মাসের পরে সব বিচারককেই নাকি নিজেদের গাড়িই ব্যবহার করতে হবে।

    গাড়ির খরচ বাবদ বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত ১৩৫০০ টাকা পাবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট পেট্রল পাম্পে গিয়ে সই করে গাড়ির তেল তুলতে হয়। বিচারকদের পকেটের টাকা যায় না। কিন্তু, পাম্প মালিকদের টাকা বকেয়া পড়ে যাচ্ছে।

    কলকাতায় পোস্টিং থাকলে মাসে ১০০ লিটার তেল পান বিচারকেরা। জেলায় থাকলে ৭৫ লিটার। যিনি জেলা জজ, বিচারকদের প্রধান, তাঁর কাছে পেট্রল পাম্পের বিল জমা পড়ে।

    জেলার এক বিচারবিভাগীয় প্রশাসকের কথায়, ‘বিল এলে তা অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জমা হতে থাকে সেই বিল। কখনও রাজ্য থেকে কিছু টাকা স্যাংশন হলে তা দিয়ে কিছু বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হয়। আবার যে কে সেই।’

    হিসেব বলছে, গত ১০ বছরে বিচার ব্যবস্থার জন্য রাজ্য বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে যেখানে বরাদ্দ ছিল ২৪ কোটি টাকা, সেখানে ২০২২-২৩-এ বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি।

    এদিকে তথ্য জানার অধিকার আইনে জানা গিয়েছে, ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে হাইকোর্টে রাজ্যের প্যানেলের আইনজীবীদের ফিজ় বাবদ প্রায় ৪২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে রাজ্যের। আর চলতি বছরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের প্যানেলের আইনজীবীদের প্রায় ৬০ কোটি টাকা

    মেটানোর একটি তালিকা কয়েকদিন আগেই প্রকাশ্যে আসার পরে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। শুধু হাইকোর্টই নয়, নিম্ন আদালতেও রাজ্যের প্যানেলভুক্ত আইনজীবীদের ফিজ় বাবদ ২০২৩-এ প্রায় ৩১ কোটি টাকা মেটানো হয়েছে বলে খবর।

    বিচারবিভাগীয় প্রশাসকদের অভিযোগ, রাজ্যে সরকারের হয়ে মামলা লড়ার জন্য বছরে যে টাকা খরচ হচ্ছে, গোটা রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা চালানোর জন্য বরাদ্দ তার থেকে কম! তার উপরে কাগজে–কলমে যতটা বরাদ্দ হচ্ছে, বাস্তবে তা না পাওয়ায় নিম্ন আদালতগুলির দুরবস্থা চরমে।

    তাঁদের হাতে ফিনান্সিয়াল পাওয়ার নেই বলেও অভিযোগ তুলেছেন বিচারবিভাগীয় প্রশাসকেরা। যেটা জেলার ডিএম-এসপি-দের হাতে আছে। তাঁদের গাড়ির বিল বকেয়া থাকে না। জেলা প্রশাসনের সমস্যা হয় না। টাকার অভাব শুধু আদালতে। শুধু গাড়ি তো নয়। জেলা আদালতের মাথার উপরে তো আরও বিবিধ দেনা!

  • Link to this news (এই সময়)