এই সময়, কাকদ্বীপ: দু’মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে রবিবার ভোররাত থেকে বঙ্গোপসাগরে ভাসল মৎস্যজীবীদের শতাধিক ট্রলার। সুন্দরবন উপকূল এলাকার কাকদ্বীপ, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘি, সাগরের মৎস্য বন্দর ও ঘাটে ঘাটে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে ছিল রবিবার।
এ বার প্রথম পর্যায়ে প্রায় ২ হাজার ট্রলার সমুদ্রে পাড়ি দেবে বলে মৎস্যজীবী সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে। প্রতিটি ট্রলারে থাকবেন ১৫ জন মৎ্যসজীবী।
এ দিন থেকেই ট্রলারগুলিতে বরফ, জ্বালানি তেল, খাবার মজুত করে সমুদ্রে রওনা দিতে শুরু করেন মৎস্যজীবীরা। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে প্রত্যেক মৎস্যজীবীর জীবনবিমা করে দেওয়া হয়েছে।
ইসরোর প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মৎস্যজীবীদের বহু ট্রলারে স্যাটেলাইট বেসড মেরিটাইম সেফটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সিস্টেম ডিভাইস অর্থাৎ ট্রান্সপন্ডার বসানো হয়েছে। গভীর সমুদ্রে যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না সেখানে এই যন্ত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্র থেকে যে কোনও বিপদ সঙ্কেত উপকূলে পাঠানো যাবে।
ভারতীয় জলসীমান্ত থেকে বাংলাদেশ জলসীমান্তে প্রবেশ করার পূর্বেই ট্রলারে সঙ্কেত পাঠাবে এই অত্যাধুনিক যন্ত্রটি। বোঝা যাবে সমুদ্রে মাছের ঝাঁকের অবস্থানও।
কাকদ্বীপ মহকুমায় মোট ৩০০টি ট্রলারে প্রাথমিকভাবে এই অত্যাধুনিক যন্ত্র লাগানো হয়েছে। ইলিশ-সহ সামুদ্রিক মাছের প্রজননের জন্য গত ১৫ই এপ্রিল থেকে ১৪ই জুন পর্যন্ত মৎস্য দপ্তর সব রকম সামুদ্রিক মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রতি বছরের মতো।
সরকারি এই নিষেধাজ্ঞা ওঠে ১৪ই জুন অর্থাৎ শনিবার মধ্যরাতে। এ দিন থেকেই গভীর সমুদ্রে রওনা দেওয়া মৎস্যজীবীদের সতর্ক করতে বন্দরে বন্দরে চলে মাইকে প্রচার। ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে লাইফ জ্যাকেট। আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রূপালি শস্য ইলিশ ও বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ শিকার করে বন্দরে ফিরবে ট্রলারগুলি।
এ দিন মৎস্যজীবী সংগঠনের কর্মকর্তা-সহ সুন্দরবনের ঘাটগুলিতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রলারের মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সহকারী মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সুরজিৎ বাগ ও মৎস্য দপ্তরের আধিকারিকেরা।
সুরজিৎ বলেন, ‘ভোর রাত থেকে ধাপে ধাপে ট্রলার সমুদ্রে রওনা দিচ্ছে এবং দেবে। কড়া নজরদারির মধ্যে নিয়ম-বিধি মেনে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা।’
ছোট বড় সব মিলিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রায় চার হাজার ট্রলারের মধ্যে অর্ধেক ট্রলার মরশুমের শুরুতে সমুদ্রে পাড়ি দেবে। গত কয়েক বছর আর্থিক ক্ষতির কথা মাথায় রেখে এ বার প্রথম ট্রিপে ইলিশের পরিমাণ দেখে তবেই বাকি অর্ধেক ট্রলার সমুদ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রলার মালিকেরা।
প্রত্যেকটি ট্রলারে ১৫ জনের বেশি মৎস্যজীবী নেওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মৎস্য দপ্তর। গত কয়েক বছরে গভীর সমুদ্রে ট্রলার দুর্ঘটনার সংখ্যাটাও বেড়েছে। সে দিকটা মাথায় রেখে এবার মরশুমের শুরুতেই গভীর সমুদ্রে যাওয়া প্রত্যেকটি ট্রলারের মাঝি এবং মৎস্যজীবীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সহ সম্পাদক বিজন মাইতি বলেন, ‘গত কয়েক বছর মরশুমের শুরুতে পর্যাপ্ত মাছ না হওয়ার কারণে সব ট্রলার এ বার একসঙ্গে গভীর সমুদ্রে যাবে না। রবিবার মধ্যরাত থেকে অর্ধেক ট্রলার গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে রওনা দেবে।
মাছের পরিস্থিতি যদি ভালো থাকে তাহলে ধাপে ধাপে বাকি ট্রলার গভীর সমুদ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেবেন মালিকরা। তবে পেট্রোপণ্যের যেভাবে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে, বিশেষ করে ডিজেল নিয়ে আমরা ভীষণভাবে শঙ্কিত।
ডিজেলের দাম এমনই থাকলে আমাদের একটি ট্রিপের জন্য প্রায় দু’লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। যদি ইলিশ না মেলে, তাহলে ট্রলার মালিকরা মরশুমের শুরুতেই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।’
তবে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সঠিক সময়ে বর্ষা নামায় এ বছর ভালোই বৃষ্টিপাত চলছে। ফলে সমুদ্রের জলের নোনা ভাব অনেকটা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি শীঘ্রই পুবালি বাতাস বইতে শুরু করবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মৎস্যজীবীরা।
ফলে শুরুর ট্রিপগুলোতেও ভালো ইলিশ মেলার আশায় বুক বেঁধেছেন তাঁরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেও পশ্চিমী বাতাস বয়ে চলার ফলে সমুদ্রে ইলিশ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও মৎস্যজীবীদের দুশ্চিন্তা আছেই।