• রাস্তার মাস্টারের পাঠশালায় শিক্ষা নেয় তিন প্রজন্ম
    এই সময় | ১৬ জুন ২০২৫
  • বিশ্বদেব ভট্টাচার্য, আসানসোল

    তাঁর নাম দীপ নারায়ণ নায়ক। পেশায় জামুড়িয়ার নামোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার সঙ্গেই শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সমাজ সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত। যাঁকে এখন গোটা দেশ চেনে ‘রাস্তার মাস্টার’ নামে। তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘থ্রি-জেনারেশন লার্নিং মডেল’ এখন শুধুমাত্র একটি শিক্ষাপদ্ধতি নয়, সামাজিক বিপ্লবও।

    ‘যেখানে দেওয়াল বন্ধ, সেখানেই রাস্তা খোলা’, এই তাঁর মূলমন্ত্র। দেওয়াল যদি বাধা হয়, তাকে আকার দাও ব্ল্যাকবোর্ডের। ঘর যদি না-থাকে, খোলা আকাশই হোক শিক্ষার ছাদ। শিক্ষক না-থাকলে শিক্ষার্থীই হোক শিক্ষক। শিক্ষা শুরু হয় ইচ্ছা থেকে, ভবন থেকে নয়।

    এমনই শিক্ষা-মডেলে তিন প্রজন্ম পড়াশোনা করে একসঙ্গে। নাতনি, মা ও ঠাকুমা অথবা দিদিমা-দাদু। পারিবারিক সম্পর্কের ভিতে তৈরি হয় শ্রেণিকক্ষ। সেখানে নাতনি অক্ষর শেখায় ঠাকুমাকে। মা হয়ে ওঠেন স্বাক্ষর।

    পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়ার নামোজামডোবার শিক্ষার্থী লছমি সরেন, মা সুকুরমনি সরেন, ঠাকুমা রাধিকা সরেন একসঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করছেন।

    শেখানো হয় বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, সাঁওতালি ভাষা। এমন অভিনব ব্যবস্থায় পড়ুয়ারা শুধু ভাষাতেই পারদর্শী নয়, ভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠছে।

    এই মডেল পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন ব্যয়সাপেক্ষ কিন্তু সর্বোচ্চ প্রভাবশালী মডেল। ‘১ টাকা বদলাতে পারে ১টি পরিবার, ১০০ টাকা বদলাতে পারে ১০০টি পরিবার।’ যেখানে দেওয়াল হয়ে ওঠে ব্ল্যাকবোর্ড। খোলা আকাশের নীচে রাস্তা হয় শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষার্থী হয় শিক্ষক। পাথর, পাতা, কাগজ, সব কিছু হয়ে ওঠে শিক্ষার উপকরণ।

    যে শিশুরা স্কুলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না, দেবনারায়ণ তাদের দরজায় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর স্কুলকে। কোভিড অতিমারির সময়ে যখন পৃথিবীই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই সময়ে রাস্তার ধারে, গাছতলায়, ঘরের দেওয়ালে চালু হয় নতুন শিক্ষার পাঠ।

    কি শেখানো হচ্ছে এই স্কুলে? এককথায় বললে নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সংস্কৃতির উন্নয়ন। প্রথম স্তরে মেয়েরা স্বাক্ষর করে তোলে মায়েদের। পরের স্তরে রয়েছে কাঁথা সেলাই, পটচিত্র, ঝুড়ি তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থান। তৃতীয় স্তরে সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ।

    সেখানে প্রাধান্য পায় আদিবাসী গান, নৃত্য ও খেলাধুলো। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গ তথা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা, ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড়–সহ বহু অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনজাতি ও আদিবাসী নারীরা আজ সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে স্বনির্ভর।

    ‘রাস্তার মাস্টার’–এর ত্রিমাত্রিক মডেলে সামিল পশ্চিম বর্ধমানের জামডোবা ও নীলপুর আদিবাসী গ্রামের পিছিয়ে পড়া আদিবাসী নারী মালতী হেমব্রম, সীমা টুডু, সুকুরমনি হেমব্রম, লক্ষী মুর্মু, নিকিতা ওরাং, বাহামনি মুর্মুরা।

    এ যেন লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে নীরব অথচ শক্তিশালী প্রতিবাদ। আগে যেখানে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, এখন সেই মেয়েরা নিজেদের মা, ঠাকুমা, দিদিমাদের অক্ষরজ্ঞান শেখাচ্ছে।

    আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলা ও ভারতের মুখ দীপ নারায়ণ। তাঁর সাফল্যের ঝুলিতে রয়েছে নানা ধরনের সম্মান। ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে ‘হান্ড্রেড ইনোভেশন সামিট’–এ তাঁর মডেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

    ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের তিনি ইউনেস্কোর জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে প্রতিনিধিত্ব করেন এবং গ্লোবাল টিচার পুরস্কারে সম্মানিত হন। তিনি–ই একমাত্র ভারতীয় এবং বাঙালি, যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

    পশ্চিম বর্ধমানের শিক্ষা দপ্তরের অতিরিক্ত জেলাশাসক সঞ্জয় পালের কথায়, ‘ফিনল্যান্ড থেকে স্বীকৃতি পাওয়ায় ওঁকে নিয়ে আমরা গর্বিত। তাঁর অমূল্য অভিজ্ঞতা পশ্চিম বর্ধমানের শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশে কাজে লাগাতে পারি।’

    তবে নির্বিকার দীপনারায়ণ। তাঁর মডেল অনুসরণ করে ১০০টিরও বেশি গ্রামে ১৮,০০০-এর বেশি শিশু ও পরিবার পেয়েছে শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা। যিনি অনায়াসে বলে ওঠেন, ‘সিঁড়ি নেই? সমস্যা নেই। আমরা সেতু বানাই। শিক্ষা শুরু হয় সম্পদ থেকে নয়, সদিচ্ছা থেকে।’

  • Link to this news (এই সময়)