• অবসরের ৫ বছর পরও বিনা বেতনে স্কুলে দর্শন পড়ান ইলিয়াস মালিতা
    বর্তমান | ১৬ জুন ২০২৫
  • দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: তিনি না থাকলে বন্ধ হয়ে যেত স্কুলের দর্শন বিভাগটাই। কারণ, তাঁর অবসরের পর দর্শনের কোনও বিকল্প শিক্ষক আসেননি। ফলে কাগজে-কলমে ‘চালু’ বিভাগকে বাস্তবে সচল রাখতে প্রয়োজন ছিল শিক্ষকের। স্কুল এবং পড়ুয়াদের কথা ভেবে তাই অবসরের পাঁচ বছর বাদেও নিয়মিত ক্লাস করাতে আসেন আনুলিয়া হাইস্কুলের দর্শনের শিক্ষক মহম্মদ ইলিয়াস মালিতা। বছরের পর বছর বিনা বেতনে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেই তিনি গড়ে তুলছেন গ্রামের বহু প্রজন্মকে। ২০০৫সালে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে আনুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন ইলিয়াস মালিতা। পায়ে সমস্যার কারণে তিনি বিশেষভাবে সক্ষম। কিন্তু, অবসরের পরেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর ‘দায়বদ্ধতা’র সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বগুলা থেকে ইলিয়াসবাবুর বাড়ি যেতে পেরোতে হয় আরও আধ ঘণ্টার রাস্তা। ভৌগোলিকভাবে আনুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩০কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা তিনি। অবসরের পাঁচ বছর বাদেও বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিদিন এই দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করে স্কুলে আসেন ছাত্র পড়াতে।

    জানা গিয়েছে, আনুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন ইলিয়াসবাবু। ২০২১সালে তাঁর অবসরের পর শিক্ষকের অভাবে বিভাগটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। তাঁর অবর্তমানে গ্রামের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই প্রশ্নই ভাবিয়ে তুলেছিল ইলিয়াসবাবুকে। তাই সিদ্ধান্ত নেন, যতদিন না দর্শন বিভাগের নতুন শিক্ষক আসছেন, তিনিই বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাবেন। এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। আনুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক পাঠায়নি শিক্ষাদপ্তর। কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দেননি ‘বৃদ্ধ’ ইলিয়াসবাবু। একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস করাতে এই বয়সেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে সময়ে স্কুলে পৌঁছে যান তিনি। তাঁর এই ‘ইচ্ছাশক্তি’কে কুর্নিশ জানিয়েই সহকর্মীরা বহুবার চেষ্টা করেছেন তাঁর হাতে অন্তত গাড়িভাড়াটুকু তুলে দেওয়ার। কিন্তু, তিনি তা নেননি। উল্টে দুই দশকের শিক্ষকতার অভ্যাস অব্যাহত রেখেই খুঁজে নিয়েছেন জীবন-সুখের রসদ।

    স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির দর্শন বিভাগের ছাত্রী মৌমিতা ঘোষ বলে, দু’বছর ধরে স্যারকে দেখছি। নিজের শারীরিক সমস্যা নিয়েও স্রেফ আমাদের কথা ভেবে উনি ক্লাসে আসেন। আর সেটাই বোধহয় ওঁর ক্লাসের প্রতি আমাদের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। দর্শনের ক্লাস থাকলে আমরা স্কুল কামাই করি না। কৃতজ্ঞমুখর গলায় ইলিয়াস মালিতার কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ক্ষৌণীশরঞ্জন গোস্বামী। তিনি বলেন, আজকের যুগে এমন শিক্ষক পাওয়াই মুশকিল। ওঁর পায়ের সমস্যা রয়েছে। তাও অবসরের পর তিনি স্কুলে আসা ছাড়েননি। আনুলিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজীব নিয়োগী বলেন, উনি না থাকলে আমরা দর্শন বিভাগটা রাখতেই পারতাম না। আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি ওঁর হাতে যৎসামান্য সাম্মানিক তুলে দিতে। কিন্তু, তিনি নেন না। উল্টে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, যতদিন না শিক্ষক আসবেন, তিনি ক্লাস করিয়ে যাবেন। পাঁচ বছর হয়ে গেল, তিনি অক্ষরে অক্ষরে নিজের দেওয়া কথা পালন করে চলেছেন।  ক্লাস নিচ্ছেন মহম্মদ ইলিয়াস মালিতা। -নিজস্ব চিত্র 
  • Link to this news (বর্তমান)