টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: বাঁকুড়ার ইন্দপুর ব্লকের ভেদুয়াশোল গ্রাম পঞ্চায়েতের নিভৃত বাঁশকেটিয়া গ্রামে আজ যেন নিঃশব্দ আতঙ্কের বাস। সন্ধে হতেই জানলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা খেলা থামিয়ে দৌড়ে ঢুকে পড়ছে ঘরের কোণে, আর বড়রা শ্বাস চেপে তাকিয়ে থাকছেন সেই একটি বাড়ির দিকে-যেখান থেকে মৃত্যু যেন তিনবার এসে তুলে নিয়ে গেছে প্রাণ। তিন বছরে তিন মৃত্যু। তা-ও আবার একই পরিবারের। প্রথমে রমেশ বাউরি। পরের বছর দাদা সোমেশ। আর এবছর-সবচেয়ে হৃদয়বিদারক, বছর আঠারোর দেবব্রত বাউরি। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। হঠাৎই এক ভোরে উঠে দেখা যায়, নিথর দেহ পড়ে আছে নিজের বিছানায়।
এই তিনটি মৃত্যুর পর থেকে আতঙ্কে কাঁটা পুরো গ্রামে। ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে গেছেন মৃতদের পরিবারের লোকজন। দিনের আলো ফুরোতে না ফুরোতেই পাড়া যেন গিলে নিচ্ছে ভয়। ভূতের আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করছেন প্রতিবেশীরাও। গ্রামেরই বাসিন্দা পদ্মা বাউরি বলেন, “ওদের বাড়ির তিন ছেলে মারা গিয়েছে। একের পর এক। কেউ বলছে ভূতের আছড়। কেউ বলছে ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক দরকার। কিন্তু আসল ভয়টা হচ্ছে, মেয়েদের কিছুই হচ্ছে না। আর ওই বাড়িটার চারপাশে সন্ধে নামতেই কেমন যেন অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। কাঁটার মতো বুক ঠেলে ওঠে।”
প্রতিদিন সন্ধেয় কান পাতলেই নাকি শোনা যায় পায়ের আওয়াজ, কান্নাকাটি, মাঝে মাঝে খিল খোলা-বন্ধ হওয়ার ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ আওয়াজ। গ্রামের তরুণেরা আর ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটে না। কারও বাড়ির আলো নিভে গেলে সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ধূপকাঠি, কেউ কেউ তুলসি গাছের চারপাশে ঘুরে নাম জপ করতে থাকেন। তবে শুধুই কি কাকতালীয়? নাকি সত্যিই কোনও অশরীরীর ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঁশকেটিয়ার নিঃস্তব্ধ গলিতে? পুলিশ বলছে, সবই গুজব, মৃত্যুগুলি স্বাভাবিক। বিজ্ঞানমঞ্চ বলছে, মানসিক ভীতির ছায়ায় ভৌতিক কল্পনা মাথাচাড়া দিচ্ছে। কিন্তু যারা হারিয়েছে, যারা বেঁচে আছেন সেই আতঙ্কের মধ্যে, তাদের কাছে বিজ্ঞান কোনও উত্তর নয়। গ্রামজুড়ে এখন শুধু একটাই কথা, “ওই বাড়ির ছেলেরা মরছে একে একে… কে পরের জন?”