গত ১ মার্চ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবকুপার মিটিংয়ে গিয়ে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁর গাড়ির ধাক্কায় এক ছাত্রের গুরুতর আঘাত লাগার অভিযোগ ওঠে। সেই সময়েই আবার তৃণমূলের কর্মী সংগঠন শিক্ষাবন্ধু সমিতির কার্যালয় পোড়ানোর অভিযোগ ওঠে একদল ছাত্রের বিরুদ্ধে।
পুড়ে যাওয়া অফিস রেনোভেট করতে তৃণমূলের কর্মী সংগঠনকে ১৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যার সিংহভাগ টাকাই বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে বলে সূত্রের দাবি। এ নিয়ে প্রবল সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কারণ, প্রবল অর্থ সঙ্কটে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ভবন প্রায় ভেঙে পড়ছে, যেখান থেকে সরাতে হয়েছে নানা বিভাগকে। ল্যাবরেটরির খরচের উপরে ৪০ শতাংশ বিধি নিষেধ রয়েছে। অর্থাৎ যা বাজেট, তার ৪০ শতাংশ খরচ করা যাবে না।
কোটি কোটি টাকার যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না বছরের পর বছর। টাকা তুলতে মাঝেমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রশাসনকে। সেখানে একটি গণ সংগঠনের কার্যালয় তৈরি করতে এই বিপুল বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরেই।
শিক্ষাবন্ধু সমিতির অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিন ছাত্রকে অ্যারেস্ট করে পুলিশ। অন্তত জনা দশেকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। সেই অফিস রেনোভেশনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিভিল ওয়ার্কের জন্য প্রায় সাত লক্ষ, ইলেকট্রিক্যালের কাজের জন্য ৭৬ হাজারের বেশি, ফার্নিচার তৈরিতে প্রায় আড়াই লক্ষ এবং অন্যান্য জিনিস যেমন স্মার্ট টিভি, এসি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, জলের মেশিন ইত্যাদি কেনার জন্য আরও ৪ লক্ষ টাকার বেশি বাজেট বরাদ্দ করেছে।
সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কটা ১৪ লক্ষ পেরিয়ে যাচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ছে, সিভিলের কাজের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার বেরিয়েছে। বাকিগুলো নিয়ে কথাবার্তা চলছে।’
যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘চার লক্ষ টাকাটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেটা নিয়ে সরকারি প্রতিনিধিরও আপত্তি রয়েছে। বাকি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ওয়ার্ক অর্ডারও ধীরে ধীরে বেরোবে।’
এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে নানা জায়গায় টাকার অভাবে হাহাকার চলছে। যেমন ফার্মাসি বিল্ডিংয়ের একাংশ ভেঙে পড়ছে। বিল্ডিংয়ের এমন ভয়াবহ অবস্থা যে মেকানিক্যাল এবং কেমিক্যাল ডিপার্টমেন্টের কিছু অংশকে অন্যত্র শিফট করতে হয়েছে। নানা জায়গায় নতুন এসি ইনস্টল করা যাচ্ছে না।
কারণ, তার জন্য নতুন ট্রান্সফর্মার বসাতে হবে। প্রযুক্তি ভবনের অবস্থাও খুব খারাপ। বিভিন্ন বিভাগের উপরেও টাকা খরচে নানা রকম এমবার্গো রয়েছে। বাংলার অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিনহা বলছেন, ‘অনেক জায়গায় ছাত্রদের বসার মতো ক্লাসরুম পর্যন্ত নেই।’
অধ্যাপক সমিতি জুটার সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায়ের বক্তব্য, ‘এই বিপুল অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুহূর্তে একটি বিশেষ সংগঠনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করার পরে কর্তৃপক্ষ কি আর নৈতিক ভাবে বিভাগগুলিকে টাকা খরচ না করার পরামর্শ বা নির্দেশ দিতে পারে?’
সংগঠনের নেতা বিনয় সিংয়ের দাবি, প্রাক্তন উপাচার্য ভাস্কর গুপ্ত দায়িত্বে থাকার সময়েই এই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হয়। সেই কমিটি এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলে। এস্টিমেট নেওয়া হয়। সেই এস্টিমেট ফিনান্স কমিটিতে পাশ হয়েছে।
এর মধ্যে অনিয়মের কিছু নেই। ভাস্কর বলছেন, ‘আমি শুধু বলে এসেছিলাম, যতটুকু জিনিস ওই অফিস তৈরির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ওদের দিয়েছিল, সেটুকু যেন দেওয়া হয়।’ এই কমিটির একজন সদস্য আবার বিনয় নিজে।
শিক্ষাবন্ধু সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েছে, পুড়ে যাওয়া ওই অফিসে দু’টি এসি, ৫৫ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি, ২০০ পিস তৃণমূলের পতাকা, ১০টা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, ঋষি অরবিন্দ, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের মতো একাধিক মনীষীর ছবি, ক্যারম বোর্ড, ৪০ হাজার টাকা ক্যাশ, ইলেকট্রিক কেটলি, ওয়াটার ফিল্টারের মতো বহু জিনিস ছিল যা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে সবই চাওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক প্রবীণ শিক্ষকের কথায়, ‘কী ভাবে এই এস্টিমেট তৈরি হলো, কারা করল, তা ভালো করে খতিয়ে দেখে টাকা বরাদ্দ করা উচিত ছিল। এত টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়।’