সুদীপ দত্ত
হরেক নাম। হরেক কিসিমের দর্শক। অমর টকিজ়, আনন্দলোক, মেঘদূত, বিশ্বদীপ, মেনকা, মায়া টকিজ়, লক্ষ্মী, কমলা, বাস-স্টপ। নিম্ন বা উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষকে একই ছাদের নীচে যে নিয়ে আসতে পেরেছিল, তার নাম—সিনেমা হল।
শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, ইসলামপুর বা মালদা জেলার এ সব সিনেমা হলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কিছু গল্পও। উত্তরবঙ্গের জেলা শহরের মানুষ তো বটেই, বিভিন্ন চা-বাগান থেকেও শ্রমিকরা মাসে অন্তত একবার বাগানের গাড়িতে চেপে আসতেন সিনেমা দেখতে।
হলে প্রথমে ছিল কাঠের চেয়ার। যাটের দশকে ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাসের জন্য তৈরি হয় গদি লাগানো চেয়ার। দোতলা ছিল মহিলাদের জন্য নির্ধারিত। পরে অবশ্য সব মিলেমিশে যায়।
ষাটের দশকে টিকিটের দাম ছিল ৯০ পয়সা আর স্টুডেন্টস কনসেশন টিকিটের দাম পড়ত ৩৭ পয়সা। পরে টিকিটের দাম আরও বাড়ে। তবে বর্তমানে মাল্টিপ্লেক্স বা মুভি থিয়েটারের মতো টিকিটের দাম কখনই ছিল না।
নতুন কোনও সিনেমা এলে রিকশায় মাইক বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করতেন আলিপুরদুয়ারের অমর টকিজ় সিনেমা হলের কর্মী শিবুদা। তাঁর সামনে থাকত ব্যান্ড পার্টি। তিনিই আবার সিনেমা হলে টর্চ জ্বালিয়ে টিকিট পরীক্ষা করে দর্শকদের নির্দিষ্ট আসনে বসাতেন।
দোতলার একটি জানলায় (হলের প্রবেশ পথের দিকে) চোঙ লাগানো থাকত। বিমল রায় ছিলেন হলের কর্মী। তিনি দর্শক টানার জন্য সিনেমা শুরুর আগে খালি গলায় অসাধারণ সব গান শোনাতেন। বেশিরভাগই ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। তাঁর গান শুনে সকলে বুঝে যেতেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনেমা শুরু হবে।
তাঁর গান এতটাই ভালো ছিল যে, দর্শকরা অনেক সময়ে বলতেন, ‘আরে! এ তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা।’ তিনি ছুটি নিলে চোঙে ‘কলের গান’ বাজানো হতো। আলিপুরদুায়রের নিউটাউন এলাকার মানুষ ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী।
তাঁরা গেটম্যানকে বলে কিছুক্ষণের জন্য হলের ভিতরে ঢুকে যেতেন। তারপর সিনেমার গানগুলি লিখে, যতটা সম্ভব গলায় তুলে নিয়ে তবেই বেরিয়ে আসতেন।
জলপাইগুড়ির সিনেমা হলের ইতিহাস লেখা হলে সেখানে পিন্টুর নাম থাকবেই। পিন্টু ছিলেন দীপ্তি টকিজ় সিনেমা হলের কর্মী। শুক্রবার নতুন সিনেমা এলে সকাল–সকাল রিকশায় মাইক বেঁধে তিনি বেরিয়ে পড়তেন প্রচারে।
তাঁর প্রচারের ভঙ্গি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, অনেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতেন। সুপারহিট ছবি এলে তাঁর হাতে শোভা পেত গোছা গোছা লাল, হলুদ বা নীল রঙের পাতলা কাগজে রেভিনিউ স্ট্যাম্প লাগানো টিকিট।
এক টাকা ৭০ পয়সার টিকিট দিব্যি পাঁচ টাকায় বিক্রি করে দিতেন পিন্টু। জলপাইগুড়ির কুলীন সিনেমা হল ছিল রূপশ্রী। অনেক শুক্রবারই সেখানে টিকিট কাটার জন্য পুরুষ আর মহিলাদের লাইন কাউন্টার থেকে চলে আসত রাস্তায়। উন্মাদনাও ছিল তুঙ্গে।
রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী বা ধর্মেন্দ্রকে পর্দায় দেখা মাত্র সেকেন্ড আর থার্ড ক্লাসে বসা দর্শকরা মহা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠতেন গুরু, গুরু বলে। হেলেন-এর নাচ পর্দায় শুরু হলে ঘনঘন সিটি বাজত। বিরতির পরে অনেকক্ষণ ধরে শোনা যেত বাদামের খোসা ভাঙার মচমচ শব্দ।
মাপা হাসি চাপা কান্নার মাল্টিপ্লেক্স এই আবেগ, এই উচ্ছ্বাস কখনও দেখেনি। কালের নিয়মে সে শুধু মুছে দিয়েছে শিলিগুড়ির উর্বশী, আনন্দলোক, আলিপুরদুয়ারের মেনকা, বাস-স্টপ, কোচবিহারের কমলা, অরুণা, ইসলামপুরের স্টার, রায়গঞ্জের আশা টকিজ়, মালদার লক্ষ্মীর মতো ছবিঘরকে।