দেবাশিস ভট্টাচার্য
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষত। স্ত্রী আরাধনা চলে গেল। শুরু হলো আমার নতুন লড়াই। সঙ্গী একমাত্র মেয়ে আরাত্রিকা। ওকে নিয়েই বর্ধমানের ইন্দ্রকাননের সাঁজবাতিতে এখন আমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে।
পেশাগত জীবনে প্রথমে ছিলাম এয়ারফোর্সে। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পরে যোগ দিয়েছিলাম ভারতীয় জীবন বিমা নিগমে। সেই কার্যকালের মেয়াদও ফুরিয়েছে। এখন মেয়ে-ই সব।
আরাত্রিকা ডক্টরেট করেছে। একটি বেসরকারি কলেজে সমাজবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান। ওর ব্যস্ততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন আমাকেও চলতে হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত তাল কাটেনি। হাসি-কান্না-অভিমান-অনুযোগ, সব মিলিয়ে বাবা-মেয়ের জুটি দিব্যি এগোচ্ছে।
আরাধনাকে হারানোর পরে তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে একটা অভিমানও তৈরি হয়েছিল। এ ভাবে আমাকে আর মেয়েকে ছেড়ে ও চলে গেল! এই দায়িত্ব একা সামলাতে পারব তো? কিন্তু জীবন চলে তার নিজের গতিতে। ধীরে ধীরে আমিও ঠিক করে ফেললাম নতুন জীবনের আদলটা কেমন হবে।
উপলব্ধি করলাম, সংসার চলবে তার মতো করেই, সেখানে কোনও নতুনত্ব হয়তো নেই, কিন্তু আমাকে তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। যে ভাবেই হোক, এই পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে।
আরাধনাকে হারানোর পরে প্রায় আট বছর তো হয়ে চলল, মেয়েকে নিয়ে আমি কিন্তু মানিয়ে নিয়েছি এই নতুন জীবনচক্রের সঙ্গে। নতুন একটা অভিজ্ঞতাও তো প্রত্যেকদিন অর্জন করছি।
সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এখন আমি যেমন সচেতন, তেমনই মেয়েকে নিয়ে আমার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যস্ততার শেষ নেই। সকাল হলেই খাবার তৈরি করে থেকে কলেজের জন্য টিফিন তৈরি করা, এগুলো নিয়ে এখন আর ভাবনাচিন্তা করার দরকার পড়ে না।
সেই সময়ও অবশ্য মেলে না! সত্যি বলতে, সোম থেকে শনিবার পর্যন্ত মেয়ে আর বাবার যেন যুদ্ধ চলতে থাকে। তারই ফাঁকে চলে মেয়ের সঙ্গে হাজারও নকল ঝগড়া, খুনশুটি। সেটা না-হলে আমাদের এই দু’জনের সংসার করার আনন্দটা কোথায়?
বছরে একবার বেড়াতে যাওয়া আমার একমাত্র শখ। তা-ও মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় মেয়ের জন্য। ওকে একা ফেলে রেখে ঘুরতেও যেন সেই আনন্দটা পাই না। বার বার করে মেয়ের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলি। ও প্রতি মুহূর্তে কী করছে, তার খবরাখবর নিই। হয়তো মেয়ে একটু বিরক্তও হয় তাতে, কিন্তু আমি তো বাবা! ওকে ছাড়া থাকব কী করে!
নতুন করে এই বিশেষ দিনটা আমার কাছে কোনও অর্থ বহন করে না। আরাত্রিকাকে নিয়ে আমার কাছে প্রত্যেকটা দিনই নতুন। আমাদের এক টুকরো এই সংসারটাই এখন সব। তার বাইরে কিছু দেখার সময় মেলে না।
(লেখক পেশায় এয়ারফোর্সের প্রাক্তন কর্মী)