জরায়ু ছিঁড়ে পেটে সন্তান ভাগ্যক্রমে রক্ষা মা-ছেলের!
বর্তমান | ১৫ জুন ২০২৫
বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমান থেকে হেঁটে বেরিয়ে আসা একমাত্র জীবিত যাত্রী বিশ্বাসকুমার রমেশকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা। সবাই বলছেন—রাখে হরি, মারে কে! কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতি সারথি বেরা ও তাঁর ১.৮ কেজি ওজনের সন্তানকে নিয়েও এখন তুমুল চর্চা। তার নির্যাসও একটাই—ঈশ্বর যদি রাখেন, কার সাহস তাকে নেবে!
মন্দিরবাজারের বাসিন্দা সারথিদেবীর ক্ষেত্রে যা হয়েছে, শহরের বহু সিনিয়র স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞও তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেননি। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলা হয় ‘অ্যাবডোমিনাল প্রেগনেন্সি’। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তান বেড়ে ওঠে মায়ের ইউটেরাস বা জরায়ুর মধ্যে। সেখানে কমপক্ষে ৩৪ সপ্তাহের পরিণতি পেলে তখনই সিজারিয়ান বা স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে নবজাতককে পৃথিবীর আলো দেখান চিকিৎসক-নার্সদের টিম। কিন্তু কখনও কখনও সন্তান কোনওভাবে জরায়ুর বাইরে চলে এসে মায়ের পেটে ভাসতে থাকে। মায়ের সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হয়ে মৃত্যু হয় তার।
এমন ঘটনা অবশ্য অতিবিরল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ২৫ হাজার প্রসবে একটি এমন ঘটনা ঘটে। আর ৪০ থেকে ৯৫ শতাংশ সময় সন্তানের মৃত্যু হয়। বিরল ব্যতিক্রম মন্দিরবাজারের বিদ্যাধরপুরের সারথিদেবী। ৩১ সপ্তাহের মাথায় কোনওভাবে জরায়ু ছিঁড়ে তাঁর সন্তানটি পেটেই ভাসতে থাকে। এখানকার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা ভেবেই নিয়েছিলেন, এই অবস্থায় সন্তানের অবধারিত পরিণতি কী হতে পারে। কিন্তু ইউএসজি করাতেই ফিটাল হার্ট সাউন্ড পেয়ে তাঁরা চমকে ওঠেন! ঈশ্বরের এ কী অলৌকিক খেলা! সন্তান যে মায়ের ইউটেরাসের বাইরে উদর গহ্বরেও জীবিত!
মেডিক্যালের স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ পার্থসারথি মিত্র বলেন, ‘সাধারণত যাঁদের এর আগে সিজার হয়েছে, অতিবিরল ক্ষেত্রে তাঁদের জরায়ুর তলদেশ ছিঁড়ে সন্তান বেরিয়ে পেটে চলে আসে। কিন্তু বেরনো মাত্রই মৃত্যুর ঘটে। এক্ষেত্রে আগে সিজারিয়ান না হওয়া সত্ত্বেও কোনওভাবে ৩১ সপ্তাহের মাথায় জরায়ুর ছাদ ছিঁড়ে বাচ্চাটি মায়ের পেটে বেরিয়ে আসে। ইউএসজিতে এই অবস্থা ধরা পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে প্রসব করানোর সিদ্ধান্ত নিই। না হলে যে দু’জনেই বিপদে পড়বে।’
পেট আড়াআড়ি কেটে বের করা হয় সন্তানকে। সেই সঙ্গে জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়ায় ব্যাপক রক্তক্ষরণের কারণে পেটে জমে থাকা ১ লিটার রক্তও বার করা হয়। রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) ও সিনিয়র স্ত্রীরোগ-প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘সত্যিই আশ্চর্যজনক ঘটনা। খুব কম হয়।’
শুক্রবার সারথি ও আশ্চর্যভাবে বেঁচে পৃথিবীর বুকে শ্বাস নেওয়া তাঁর সন্তানের সঙ্গে দেখা হল মেডিক্যালের সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিটের কাছে। নতুন মা বলছিলেন, ‘আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি। শুধু অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছিল পেটে।’ ছোট্ট করে হাই তোলা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওর বাবা যে কী খুশি! বলছে, মহাদেবের কাছে মানত করে তবে একে পেয়েছি। এর নাম হবে সোমনাথ।’ অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী ডাঃ দৃষ্টি মাঝির মতো বেশ কয়েকজন পিজিটি। বৃষ্টি বললেন, ‘মায়ের জরায়ু থেকে বেরিয়েও গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে ছিঁড়ে যাওয়া জরায়ুর সঙ্গে প্লাসেন্টার মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল বাচ্চাটি। তাই বেঁচে গিয়েছে। মিরাকল ছাড়া আর কী বলা যাবে!’