• অতি সংকীর্ণ কামরায় বন্দি ১৪৬ ইংরেজ! অন্ধকূপ হত্যা সত্যিই ঘটান সিরাজ?
    প্রতিদিন | ১৫ জুন ২০২৫
  • বিশ্বদীপ দে: ‘আলীবর্দ্দি খাঁর মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌল্লা নবাব হইলেন… তিনি ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারে মত্ত হইয়া ইংরাজগণকে কলিকাতায় আক্রমণ করিয়া বসিলেন এবং তাঁহাদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠনপূর্ব্বক কতকগুলি ইংরাজকে হত্যা করিয়া মুর্শিদাবাদে ফিরিয়া আসিলেন।’ ঐতিহাসিক হরিচরণ দাসের (বানান অপরিবর্তিত) লেখায় সংক্ষেপে যে কথা বলা হয়েছে, সেখানে ‘অন্ধকূপ হত্যা’র কোনও বর্ণনা নেই। এমন অনেক ঐতিহাসিকের লেখাতেই কিন্তু এই হত্যার উল্লেখ নেই। আসলে এই হত্যাকাণ্ড সেই অর্থে ইতিহাসের অংশ হতেই পারেনি। মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী জন হলওয়েলের বর্ণনাই এই তথাকথিত হত্যাকাণ্ডের উপজীব্য। কিন্তু হলওয়েল সাহেব যা বলেছিলেন তা কি আদৌ বাস্তবসম্মত?

    সেপ্রসঙ্গে সিরাজের কলকাতা আক্রমণ সম্পর্কে আগে বলা প্রয়োজন। তখনও পলাশীর যুদ্ধ হয়নি। ‘বণিকের মানদণ্ড’ হয়ে ওঠেনি ‘রাজদণ্ড’। ১৭৫৬ সালে মারা গেলেন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ। তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌল্লা বসলেন বাংলার মসনদে। এদিকে কলকাতায় তখন সদ্য নির্মিত হয়েছে ফোর্ট উইলিয়াম। সিরাজের দূত পৌঁছায় ইংরেজদের কাছে। তাঁর সোজা বার্তা ছিল, ফোর্ট উইলিয়ামকে আর যেন বাড়ানো না হয়। কিন্তু নবাবের দূতের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলেন ইংরেজ রাজপুরুষ রজার ড্রেক। এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন ড্রেক সাহেব নাকি নবাবের পত্র ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ছুরে মারেন দূতের মুখে। কেউ আবার বলেন, এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও খারাপ ব্যবহারই করেছিলেন তিনি। মোদ্দা কথা, দূতকে অপমানের বিষয়টি ভুল নয়। এই খবর পেয়েই সৈন্যসামন্ত নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করলেন বাংলার নতুন নবাব। ১৭৫৬ সালের ১৬ জুন। সিরাজের সঙ্গে ছিল প্রায় তিরিশ হাজার সেনা। লালদিঘির কাছে শুরু হল লড়াই। দিনদুয়েকের মধ্যে হেরে পর্যদুস্ত ইংরেজ বাহিনী। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের দখল চলে গেলে সিরাজের হাতে। কলকাতার নামও বদলে দিলেন নবাব। নাম রাখলেন ‘আলিনগর’।

    এরপরই ঘটে ‘অন্ধকূপ হত্যা’। মুজিবর রহমানের ‘অন্ধকূপ-হত্যা-রহস্য’ বইয়ে পাচ্ছি ‘…নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা কলিকাতা নগরী অধিকার করিয়া ১৪৬ জন ইংরাজকে ১৮ বর্গ-ফুট পরিমিত একটী ক্ষুদ্র কক্ষে সমস্ত রাত্রি বন্দী করিয়া রাখেন; ইহাতে তাহাদের মধ্যে ১২৩ জনের শ্বাসরুদ্ধ হইয়া মৃত্যু ঘটে। ভারত ইতিহাসে এইরূপ নির্ম্ম অত্যাচারের দৃষ্টান্ত আর দৃষ্ট হয় না…’। (বানান অপরিবর্তিত) তিনি জানিয়েছেন, ব্রিটিশ ভারতের স্কুলে কচি ছেলেপুলেদের বইয়ে এমনটাই লেখা থাকত। বলা হয় ফোর্ট উইলিয়ামে নাকি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন সিরাজ। ওই ছোট্ট কামরায় তাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান অধিকাংশ মানুষ। এই সমস্ত দাবিই আসলে একজনের। তিনি জন হলওয়েল। ‘ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস’ নামের একটি বইয়ে এই নিয়ে বিশদ বিবরণ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে নিহতদের স্মরণে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। যদিও ১৮১৮ সালে সেটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন লর্ড হেস্টিংস। অর্থাৎ ইংরেজদের নিজেদের মধ্যেও একটা অস্বস্তি ছিল অন্ধকূপ হত্যা নিয়ে।

    দৈর্ঘ্যে ১৫ ফুট। প্রস্থে ১৮ ফুট। এইরকম ছোট্ট ঘুপচি একটা ঘরে কি কোনওভাবে ১৪৬ জনকে আঁটানো সম্ভব? আসলে সিরাজকে হেয় করতেই ইংরেজরা এমন গল্প ফেঁদেছিল। পরবর্তী সময়ে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ‘সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থে যুক্তি-তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন পুরো ব্যাপারটাই আসলে সাজানো। মুজিবর রহমানের বইয়ে দাবি করা হয়েছে, আসলে পুরোটাই ছিল প্রোপাগান্ডা। আদতে যা ছিল ঘটেছিল তা হল ‘বেগতিক দেখিয়া গভর্ণর ড্রেক অনেক সৈন্য ও কর্ম্মচারীসহ নৌকাযোগে দুর্গ হইতে পলায়ন করেন। হলওয়েল এবং আরও কিছু সৈন্য ও কর্ম্মচারী পলাইবার কোন সুবিধা করিতে না পারিয়ে ৩০ ঘণ্টা পর্য্যন্ত দুর্গরক্ষা করিয়া ২০শে জুন তারিখে সন্ধ্যার পূর্ব্বে নবাবের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।’ (বানান অপরিবর্তিত) এরপর হলওয়েল নবাবের সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনি মদ্যপানে বেশ টলমল করছেন! সেই সময় রমজান চলছিল। নবাব আর সেদিন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি। সেরাতের মতো একটা ঘরে হলওয়েল এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের (ওয়ালকট, বারডেট প্রমুখ) বন্দি রাখেন। পরে তাঁদের মুক্তিও দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হলওয়েল তৈরি করলেন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। যার জেরে অন্ধকূপ হত্যার কাহিনি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আসলে ইংরেজদের মৃত্যুবরণ করার ঘটনা মিথ্যে নয়। কিন্তু সেটা নবাবের বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে। যে ১২৩ জনের নাম মৃতের তালিকায় রাখা হয়েছিল, পরে দেখা যায় তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্গজয়ের আগে বা সেই সময়ই মারা যান। কেউ কেউ আবার পরবর্তী সময়েও ইংরেজ বাহিনীরই অংশ ছিলেন!

    এভাবেই তৈরি করা হয়েছিল যে তালিকা! এমনটাই দাবি বহু ইতিহাসবিদের। আবার কেউ কেউ এমনও বলেন, যদি এমন কিছু ঘটেও থাকে তাহলে তা সিরাজের অজানাই ছিল। তবে সেই মতের দাবিদার বেশি নন। কেউ আবার বলেছেন মৃতের সংখ্যাটাও বাড়িয়ে বলা। ওইটুকু ঘরে এমন কোনও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলেও অতজনকে হত্যা করার মতো পরিসর মোটেই ছিল না। তবে যত সময় গড়িয়েছে তত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে অন্ধকূপ হত্যা একটা সাজানো ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। আদৌ যা ঘটেনি তাকেই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছিল ইংরেজরা। কিন্তু মানতেই হবে, সেই ইতিহাস পুরোটাই মনগড়া হলেও তা এতদিনে টিকে গিয়েছে এর রোমহর্ষক বিবরণের জন্যই। এত বছর পেরিয়েও তাই অন্ধকূপ হত্যা বারবার আলোচনায় উঠে আসে।
  • Link to this news (প্রতিদিন)