• ‘মানিকদা, চরিত্র না থাকলে একটা দুশ্চরিত্রই না হয় দিন’! শিশুর মতো কেন কেঁদেছিলেন কামু?
    আনন্দবাজার | ১৪ জুন ২০২৫
  • গল্পটা অনেকেরই জানা। সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে চায়ের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে বিস্কুট। অতিথি তাতে এক কামড় দিয়েই গৃহকর্ত্রী বিজয়া রায়কে প্রশ্ন করলেন, ‘বৌদি, এগুলোতে সাইলেন্সার লাগিয়েছেন বুঝি?’ অর্থাৎ, বিস্কুট মিইয়ে যাওয়ায় চিবোলে শব্দ হচ্ছে না!

    সাজানো কোনও সংলাপ নয় এটা। অভিনেতা কামু মুখোপাধ্যায়ের কথা বলার ধরনটাই ছিল এ রকম। সত্যজিৎ নিজেই লিখেছেন, ‘কামুর আরেকটা গুণের কথা এখানে বলতেই হয়। সেটা হল, কোনও কিছুর বর্ণনা দিতে অপ্রত্যাশিত উপমার ব্যবহার’। পরের গল্পটাও সত্যজিৎ নিজেই শুনিয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির শুটিং চলাকালীন। শুটিং হচ্ছে রাজস্থানের জৈসলমিরে। সত্যজিৎ-সহ অভিনেতারা উঠেছেন সেখানকার রাজার অতিথিশালা জওহর নিবাসে। একদিন সকালে উঠে কামু জানালেন, আগের রাতে না কি খড়কাটা মেশিনের শব্দে তাঁর ঘুম হয়নি। সকলে তাজ্জব! রাজার অতিথিশালায় খড়খাটা মেশিন! কামু খোলসা করে বললেন, তাঁর ঘরেই শুয়েছিলেন সহ-অভিনেতা বর্ষীয়ান গোবিন্দ চক্রবর্তী। সিনেমায় গুপীর বাবা। রাতে তাঁর কাশির ফিট হয়। গল্পের শেষে সত্যজিতের সরস টিপ্পনি, ‘যারা খড়খাটা মেশিন আর হেঁপো বুড়োর কাশির শব্দ শুনেছে, তারাই বুঝবে উপমাটা কী মোক্ষম’।

    পুরনো দিনে টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো পাড়ায় একটা রসিকতা শোনা যেত, কোন কামুকে চাই আপনার? অ্যালব্যের, না মুখার্জি?

    বাঙালি সিনেমার দর্শক এবং পরিচালককুল অভিনেতা কামুকে কতটা চেয়েছেন বলা মুশকিল. তবে যতটুকু পেয়েছেন, বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের কারণে, তার মূল্যায়ন বোধহয় এখনও হয়নি। নায়ক তিনি ছিলেন না। চরিত্রাভিনেতা হিসাবেও প্রায় সাড়ে তিন দশক (১৯৫৯-১৯৯৩) ধরে তিনি যে কাজ করেছেন, সংখ্যার নিরিখে তা যৎসামান্য। সত্যজিতের ছবির বাইরে অন্য পরিচালকদের সঙ্গে কামুর কাজ আলাদা ভাবে মনে রাখার মতো কিছু হয়নি। অথচ, তাঁর সপ্রতিভ, সাবলীল এবং স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় দক্ষতা যে যথেষ্টই ছিল তার প্রমাণ শুধু ‘নায়ক’ ছবির প্রীতীশ সরকার বা ‘সোনার কেল্লা’র মন্দার বোসেই আটকে নেই। ‘চারুলতা’য় ভূপতির এক অনামা বন্ধু বা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর গুটিকয় এক ঝলকের চরিত্র, বিশেষ করে ছবির শেষে মন্ডাবোঝাই হাঁড়ির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া লোলুপদৃষ্টি ক্ষুধার্ত সৈনিকের ভূমিকাতেও অভিনেতা হিসাবে নিজের জাত চেনাতে কসুর করেননি কামু মুখোপাধ্যায়।

    লম্বা চওড়া পেটানো চেহারা হলেও কামুর মুখের অভিব্যক্তি, চালচলন, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি যে বিশেষ-বিশেষ ধরনের চরিত্রের সঙ্গে মোক্ষম ভাবে মেলে, মূলধারার বাংলা ছবিতে তা কমই এসেছে। যেমন, ‘সোনার কেল্লা’র অন্যতম ভিলেন মন্দার বোস। মুকুলের খোঁজে এসে ‘আমরা তো বেলুচিস্তান থেকে আসছি, তাই কলকাতার রাস্তাগুলো...’, অথবা ওই বোতলে কী আছে, সেই প্রশ্নের জবাবে ‘ওতে! আখের শরবৎ, পূর্বজন্মে খেয়েছ ওই জিনিস?’-র মতো সংলাপ অভিনবত্ব পেয়েছে কামুর বলার ধরনে, চোখ-মুখের ভাবে। আবার ওই ছবিতেই পর্দায় কামুকে দেখার আগেই তাঁর কণ্ঠে শুনি ‘লে হালুয়া’র অমন ‘অথেনটিক’ উচ্চারণ। লালমোহনবাবুর হাতে নেপালের জঙ্গ বাহাদুর রানার ভোজালি দেখে ‘সে তো জং দেখেই বোঝা যাচ্ছে’র অনুপ্রাসও অবিস্মরণীয় কামুর শ্যামবাজারি ধাঁচে বলার টানে। আবার এর বিপরীতেই পাই ‘নায়ক’-এ এক ছোট বিজ্ঞাপন সংস্থার মালিক প্রীতীশ সরকারকে। ম্যাট্রিকে ভূগোলে ছাপান্ন পাওয়া ‘ভূপর্যটক’ মন্দার বোসের ধর্মতলার জ্যাকেট ও বাটার জুতোর বদলে এখানে মিস্টার সরকারকে দেখি স্যুট-টাই পরিহিত এগজ়িকিউটিভের রোলে, অতীত-হলিউডের ডাকাবুকো অভিনেতা এরোল ফ্লিন ধাঁচের গোঁফ-সমেত। যে লোকটা একটা দাঁও মারার আশায় নিজের বৌকে এক ঘোড়েল ব্যবসায়ীর (রণজিৎ সেন, ছবিতে হরেন বোস) সঙ্গে সামান্য একটু ফষ্টিনষ্টিতে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। হরেন বোসের জাপান সফরের কাহিনি শুনে চোখে-মুখে যথাসাধ্য বিস্মিত বিনয়ের ভাব ফুটিয়ে, সরে যাওয়া টেবিল ক্লথ ঝেড়েঝুড়ে সাফ করে প্রাণপণ মোসাহেবির চেষ্টা এবং তার গোটা পরিকল্পনা কতটা সফল হবে, সে-বিষয়ে তার নিজেরই দ্বিধা থাকা মিস্টার সরকারের চরিত্র কামুর সাধারণ ইমেজের সঙ্গে খাপ খায় না। সম্ভবত, সেই কারণেই ওই অভিনয় এতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে।

    কামু সম্পর্কে যে-সব সরস কাহিনি শোনা যায়, তার মূলে রয়েছে ওঁর ডানপিটে স্বভাব আর একেবারে স্বকীয় বাচনভঙ্গি। ছোট চরিত্রে থাকলেও শোনা যায় সত্যজিতের ইউনিটের সঙ্গে, বিশেষ করে আউটডোর শুটিংয়ে সবসময়েই থাকতেন কামু। ভিড় সামলানো থেকে শুটিং চলাকালীন বিচিত্র জটিল পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব অন্যদের সঙ্গে তিনিও নিতেন। আর এ-সব ব্যাপারে সত্যজিৎও তাঁর ডানপিটেমোর উপরে ভরসা করতেন। ‘সোনার কেল্লা’য় জোধপুরের সার্কিট হাউসে ফেলুদার বিছানায় যে কালান্তক কাঁকড়া বিছেটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটি কামু নিজের হাতেই ধরেছিলেন। সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দিও হয়। কিন্তু পাছে দর্শক ভেবে বসে মন্দার বোস ফেলুদার চেয়ে বেশি সাহসী, তাই সেটি না কি শেষপর্যন্ত ছবিতে রাখা হয়নি।

    ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ও ‘সোনার কেল্লা’র আউটডোর শুটিংয়ে একাধিকবার ট্রেনের একই বগিতে সত্যজিৎ ও অন্য অভিনেতাদের সঙ্গে থাকতেন কামুও। ভোরের দিকে কোনও স্টেশনে ট্রেন থামলেই কামুর বাজখাঁই চিৎকার শোনা যেত ‘জাগো বাঙালি’! সেই হুঙ্কারে বগিসুদ্ধ সকলেরই ঘুম ভেঙে যেত। তারপর কামুর উদ্যোগেই চলে আসত চায়ের ভাঁড়।

    বাংলা ছবিতে ভাল স্টান্টম্যানের অভাবের কথা সত্যজিৎ বার বার বলেছেন। ‘জলসাঘর’ ছবিতে ঘোড়া থেকে জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের (ছবি বিশ্বাস) পড়ে যাওয়ার দৃশ্যের জন্য খাঁ সাহেব বলে সে-যুগের একজন ডাকসাইটে স্টান্টম্যানকে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ঘোড়া থেকে এক বার বালির উপরে পড়েই তাঁকে তিন দিনের জন্য বিছানা নিতে হয়েছিল। ‘সোনার কেল্লা’র স্টান্ট— বিশেষ করে হাড় কাঁপানো শীতের রাত্তিরে রামদেওরা থেকে জৈসলমিরগামী চলন্ত ট্রেনে লোহার রড ধরে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়া দৃশ্য সম্পর্কে সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘এ দৃশ্য বিদেশে তোলা হলে অভিনেতার বদলে পেশাদারি স্টান্টম্যান ব্যবহার করা হত।... এই দৃশ্যের জন্য অবিশ্যি কামু গোড়া থেকেই বলে রেখেছিল যে এই অসমসাহসিক কাজটা ও নিজেই করবে। কামুর ডানপিটেমোর নমুনা আমরা আগেও পেয়েছি, তাই তার কথায় ভরসা না করার কোনও কারণ দেখিনি’। বলা বাহুল্য, কামু নিজেই সেই সার্কাসের খেল দেখিয়ে সুকঠিন শটটা এক বারেই উতরে দিয়েছিলেন।

    নানা রকম হাতসাফাই, ছোটখাটো ম্যাজিকে দক্ষতা ছিল কামুর। ‘সোনার কেল্লা’য় যার কিছু নমুনা দর্শকেরা সবাই দেখেছেন। ‘হীরক রাজার দেশে’তে কামুর ছিল রাজার কোষাগারের প্রহরীর পার্ট। ভাবতে ইচ্ছে করে, ‘হীরক রাজার দেশে’-তে তো পুরুলিয়ায় শুটিংয়ের সময়ে উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালার এক ডজন শিশুর তত্ত্বাবধানের অনেকটা দায়িত্বও ছিল তাঁর উপরে। নানা রকম ম্যাজিক দেখিয়ে ওই বাচ্চাদের মাতিয়ে রাখতেন কামু। এক দিন সকালে ব্রেকফাস্টে লুচি-তরকারি দেওয়া হয়েছে। একজনকে মাত্র দুটো লুচি খেতে দেখে কামু বললেন, ‘এই বয়সে মাত্র দু-খানা লুচি খাচ্ছিস! দেখ তা হলে লুচি কত বেশি খাওয়া যায়।’ এই বলে আর একজনের পাত থেকে গপাগপ লুচি মুখে পুরতে শুরু করেন কামু। খানিক পরে আর একটি বাচ্চাকে জিগ্যেস করলেন, ‘গুনেছিস, কটা খেলাম?’ সে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, দশটা লুচি খেয়েছো তুমি।’ কামু এ বার হা-হা করে হেসে বললেন, ‘এক্ষুণি সব পেট থেকে বের করে আনছি।’ হাত ঘোরাতেই দেখা গেল, ম্যাজিশিয়ানের মতো কামুর হাতে দশখানা লুচিই হাজির! সন্দীপ রায়ের ‘ফটিকচাঁদ’-এ অবিস্মরণীয় হারুন আল রাশিদের অনেকগুলো জাগলিং স্বহস্তে করেছিলেন কামুই, পেশাদার জাগলার অভয় মিত্রের থেকে শিখে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ মগনলাল মেঘরাজের মাইনে করা নাইফ থ্রোয়ার অর্জুনের ভূমিকাটাও স্মরণীয়। কামুর সে-সময়ের অমন তেল-তাগড়াই চেহারা কী ভাবে মেকআপ এবং অভিনয়ের জোরে ক্ষয়কাশে ভোগা রোগীতে পরিণত হয়েছিল, সেটাই বিস্ময়ের! মগনলালের প্রাইভেট সার্কাসে কোনও স্মার্ট মন্দার বোস নাইফ থ্রোয়িং করলে সে দৃশ্য হয়তো স্বাভাবিক হতো, কিন্তু স্মরণীয় হতো কী? চশমায় বোতলের কাচ. লখনউয়ি সাদরি কোটের বুকে মেডেলের সারি নিয়ে লজঝড়ে অর্জুনের নিখুঁত লক্ষ্যভেদ সেই বৈপরীত্যকেই শৈল্পিক সঙ্গতি দিয়েছে।

    ছবিতে বড় রোল না-পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ ছিল কামু মুখোপাধ্যায়ের। বস্তুত, ‘নায়ক’, ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘ফটিকচাঁদ’ ছাড়া অন্য কোনও ছবিতেই সে-ভাবে বড় পার্টের সুযোগও তিনি পাননি। বিষয়টি সত্যজিতের কাছে তোলায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, জাত অভিনেতা ছোট রোলেও নিজেকে চেনাতে পারে। এ-প্রসঙ্গে সত্যজিতের ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পের সেই অংশটা মনে পড়ে, যেখানে পটলবাবু শুধুমাত্র ‘আঃ’ বলতে হবে শুনে মুষড়ে পড়ার পরে তাঁর নিজের মনে জেগে উঠেছিল অতীতের একটি ক্ষীণ স্মৃতি। তাঁর অভিনয়ের গুরু তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ‘যত ছোট পার্টই তোমায় দেওয়া হোক, তুমি জেনে রেখো তাতে কোনও অপমান নেই। শিল্পী হিসেবে তোমার কৃতিত্ব হবে সেই ছোট্ট পার্টটি থেকেও শেষ রসটুকু নিংড়ে বার করে তাকে সার্থক করে তোলা। থিয়েটারের কাজ হল পাঁচজনে মিলেমিশে কাজ। সকলের সাফল্য জড়িয়েই নাটকের সাফল্য।’

    কথাগুলো কামুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে, কামু ছিলেন মূলত পরিচালকের অভিনেতা। তাঁর অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য টের পাওয়া যেত দক্ষ পরিচালকের হাতেই। সত্যজিতের ছবি ছাড়াও তাঁর দু’টি উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে ১৯৮৪-তে মুক্তি পাওয়া গৌতম ঘোষের ‘পার’ (চটকলের শ্রমিক সর্দার) এবং ১৯৮৮-তে মুক্তি পাওয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘ফেরা’-য় (যাত্রাদলের মালিক মন্টু দত্ত)। অল্প কাজ করলেও ভাল কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা যে কর্মাশিয়াল বাংলা ছবিতে (অন্তত সে আমলে) কম, সেটা কামুও বুঝতেন। তাই শোনা যায় সত্যজিৎকেই এ বার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আব্দার করেছিলেন, ‘মানিকদা, চরিত্র না থাকলে একটা দুশ্চরিত্রই দিন।’ একটা পর্বে এ-নিয়ে তাঁকে বলতে শোনা যেত, ‘মন্দার বোসের বাজার মন্দা।’

    কামু মুখোপাধ্যায়ের আসল নাম কামাখ্যানাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর জীবনের ঘটনা সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। যেটুকু জানা যায় তা হল, কামুর জন্ম ১৯৩১ সালের ১৪ জুন, অবিভক্ত বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশে) মাদারিপুরে। বাবা ছিলেন হোমিয়োপ্যাথির চিকিৎসক। অল্প বয়সেই কলকাতায় চলে আসে কামুর পরিবার। বাস করতেন সিআইটি রোডে। কামুর প্রথম ছবি উত্তমকুমার, ছবি বিশ্বাস অভিনীত মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘সোনার হরিণ’। তাতে ভিলেন আবদাল্লা’র চরিত্রে একটি ছোট পার্টে কাজ করেন কামু। সেটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে। ওঁর শেষজীবন কাটে দীর্ঘ অসুস্থতায়। প্রায় এক দশক রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগে ২০০৩ সালে ৬ ডিসেম্বর তাঁর প্রয়াণ ঘটে। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কিছু নাটকেও অভিনয় করেছেন কামু। ‘বিষ’, ‘অনন্যা’, ‘বেণী সংহার’ প্রভৃতি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন বলে তাঁর উইকিপিডিয়ার জীবনপঞ্জিতে উ্ল্লেখ রয়েছে।

    ‘সোনার হরিণ’-এর পরে উত্তমকুমার, কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত প্রশান্ত দেবের ‘কখনো মেঘ’ ছবিতে কামুকে দেখা যায় সতু বসাক নামে আর একটি ভিলেনের চরিত্রে। কামু অভিনীত অন্যান্য জনপ্রিয় ছবির মধ্যে রয়েছে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মৌচাক’, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘হংসরাজ’, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভোম্বল সর্দার’ প্রভৃতি। একেবারে শেষ পর্যায়ে কামুর একটি ছবি স্মরণ দে-র ‘পলাতকা’ (১৯৯১)। অতিথি-শিল্পী হিসেবে বঙ্কিম ঘোষের বিপরীতে এক ট্রেনযাত্রীর দৃশ্যে। সত্যজিতের নিতান্ত অক্ষম অনুকরণে কামু সেখানে মন্দার বোসের আদলে একজন বাতেলাবাজ ব্যবসায়ী, যিনি আফ্রিকায় বাঁদর চালানের ব্যবসা করে দশ লাখ টাকা কামিয়েছেন। কামুর শেষ ছবির যে উল্লেখ পাচ্ছি সেটা হল, তাপস পাল অভিনীত ইন্দ্রনীল গোস্বামীর ‘অমর কাহিনী’ (১৯৯৩)। তপন সিংহের ‘এক যে ছিল দেশ’-এর এক খাবলা এবং ১৯৭০-এর দশকের হিন্দি বাজারি ছবির এক খাবলা নিয়ে একান্ত ভাবে বিস্মরণযোগ্য ছবিটি কায়ক্লেশের সঙ্গে অনুধাবন করতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম স্বল্প এবং ছবির বিচারে সম্পূর্ণ এক অবান্তর ভূমিকায় কামুকে দেখে। আচমকা বিকৃতমস্তিষ্ক এক জমির দালালের রোলে কামুর কাজ দেখে মনে হয়েছিল, হায় রে! এই তো সিনেমার রসে টইটম্বুর সত্যজিৎ-কাহিনির ‘ব্রজবুড়ো’!

    ভাল, সদর্থক ছবি তো কেবল অভিনেতা-নির্ভর নয়, সে এক সামগ্রিক শিল্প। অভিনেতা তাঁর কাজ করেন, কিন্তু তাঁকে দিয়ে একান্ত প্রয়োজনীয় কাজটুকু করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পরিচালকের উপরেই বর্তায়। কামুর ক্ষেত্রে সেই কাজটা করতে পেরেছিলেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই। অভিনেতার একান্ত ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে কাহিনির চরিত্র রূপায়ণের কাজে এ রকম অমোঘ ভাবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা সত্যজিতের মাপে আর কোনও ভারতীয় পরিচালকেরই বোধহয় নেই। আর স্রেফ সেই কারণেই ওঁর ছবির অত্যন্ত ছোট, মাইনর ক্যারেক্টরও দাগ রেখে যায় দর্শকের মনে। কামু নিজেও সেটা উপলব্ধি করতেন। তা না-হলে, সত্যজিতের প্রয়াণের পরে নন্দন চত্বরে প্রৌঢ় অভিনেতাকে অবুঝ শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল কেন?

    সত্যজিতের লেখায় কামু প্রসঙ্গ একাধিবার এসেছে। উনি এ-ও লিখেছেন যে কামুর বিচিত্র কাণ্ডকারখানা নিয়ে লিখতে গেলে একটা আস্ত বই হয়ে যায়। কিন্তু কামুর জবানিতে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় মানিকদাকে নিয়ে কোনও কথাই সম্ভবত লিপিবদ্ধ হয়নি। সত্যজিৎ প্রয়াণের পরে মিডিয়া সত্যজিতের প্রায় সকল জীবিত অভিনেতার সঙ্গে কথা বলেছে। কামুর সঙ্গে কেউ বলেছেন কি? সেটা জানতে পারলে ভাল লাগবে।

    পরিশেষে কামুরই একটি মজার কাণ্ডের (যার সূত্র আবারও সত্যজিৎ) উল্লেখ করি। রাজস্থানের জয়পুরে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর শুটিং চলছে। দলে ছিলেন রাজকুমার লাহিড়ি নামে এক অভিনেতা। রাজস্থানে পৌঁছেই বাড়ির মেম্বারদের ফরমাস মতো তিনি নানা সাইজ়ের নাগরা কিনতে শুরু করেন। অবশেষে সেই নাগরার বান্ডিলের আয়তন বেড়ে হয়ে দাঁড়ায় ধোপার পুঁটলির মতো। একদিন সন্ধেয় লাহিড়ি মশাই পরিচালকের কাছে আমতা আমতা করে অভিযোগ করেন যে, তাঁর সাধের নাগরার বান্ডিল হাওয়া। কেউ বোধহয় সেটা ‘ইয়ে’ করে নিয়েছে। সত্যজিতের সন্দেহ ছিল, এর পিছনে নির্ঘাৎ কামুর কারসাজি হয়েছে। কামুকে জিগ্যেস করতেই তিনি বলেন, ‘কে বলেছে নাগরা নিয়েছে? নাগরা ওঁর ঘরেই আছে, আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।’ লাহিড়ি মশাইয়ের ঘরে ঢুকে বিস্মিত পরিচালক দেখেন, ‘সুউচ্চ সিলিংয়ের কড়ি-বরগায় বাঁধা দড়িতে ঝুলছে নাগরার ঝাড়লণ্ঠন। এতটাই উঁচুতে যে, সেটা চোখে পড়ার কথাই নয়। তারপর পাশে দাঁড়ানো হতভম্ব লাহিড়ি মশাইয়কে তিরস্কারের সুরে কামু বলেন, ‘আপনি এ রকম চুকলিবাজ জানলে রাত্তিরে আপনাকে বিছানায় শুইয়ে ওই দড়ি কেটে দিতুম, তখন দেখতেন নাগরা Falls কাকে বলে!’

    এর কয়েকবছর পরে ‘সোনার কেল্লা’ বইয়ের মন্দার বোসকে ছবির চরিত্রে আনার সময়ে কি কামুর সহজাত বাচনভঙ্গি মাথায় রেখেই সংলাপ সাজিয়েছিলেন সত্যজিৎ? মিলের ভাগটা কিন্তু কানে বাজার মতোই।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)