দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
‘ওরা আসে নিশুতি রাতে। প্রতি অমাবস্যায়। তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক শুনশান অদৃশ্যা মনে হয় এখানে কেউ বেঁচে নেই, কোনো বাড়িঘর নেই। বাতাসে গাছের ডগাগুলো কাঁপে, বাঁশবনে একটা বাঁশের সঙ্গে আর একটা বাঁশের ঘষা লেগে শব্দ হয় কর-র-র কর, কর-র-র কর!’
এমনই লিখেছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কাহিনির নাম ছিল, ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প।’
এই কাহিনিও অনেকটা তেমনই, শুধু একটাই পার্থক্য। এখানে সেই ভূত বাবাজিদের দৌলতে রাস্তায় বসেছে আলো! পালা করে রাতে পাহারা দিচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। তাঁরা মানুষকে সাহস দিচ্ছেন।
ঘটনাস্থল বাঁকুড়ার ইন্দপুর ব্লকের ভেদুয়াশোল পঞ্চায়েতের বাঁশকোটরা গ্রাম। সেখানে খুব ভূতের ভয়। আতঙ্কে তাই নিজেদের ভিটে ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কয়েকটি পরিবার। তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং বিজ্ঞান মঞ্চের পক্ষ থেকে ঘনঘন প্রচারে কেটেছে ভূতের ভয়। নিজের ভিটেতেই রয়েছে পরিবারগুলি।
শুধু তাই নয়। রাস্তায় এখন বসেছে আলো। বাসিন্দাদের সাহস দিতে গ্রামে পুলিশ পাহারা থাকছে রাতভর। বাঁশকেটিয়া গ্রামের একটি পাড়ায় প্রায় ৪০টি পরিবারের বাস। মাত্র চার বছরের মধ্যে ওই পাড়ার এক পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়।
দিন কয়েক আগে মৃত্যু হয় পরিবারের ১৯ বছরের এক যুবকের। তার আগে মৃত্যু হয় বাবা এবং কাকার। ওই যুবকের মৃত্যুর পরে পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র আত্মীয় বাড়িতে।
আর যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের উপরে ভর করেছে ভূতের ভয়। এই অবস্থায় ওই বাড়ির আশপাশের পাঁচ-সাতটি পরিবার গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। খবর পেয়ে গত সপ্তাহে গ্রামে যান ইন্দপুরের বিডিও এবং থানার ওসি।
বাসিন্দাদের বোঝান তাঁরা। পরে আবারও তাঁরা সেই পাড়ায় গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসেন। বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরাও বাসিন্দাদের বোঝান। খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে ওই পরিবারগুলি এখনও রয়েছেন।
তবে ভয় যে কেটে গিয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। পাড়ার বাসিন্দাদের বক্তব্য, ‘কয়েক বছরের মধ্যেই ওই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। ওই পরিবারের লোকজনও তো চলে গিয়েছে অন্য জায়গায়। ওই ফাঁকা বাড়ি থেকে রাতে নানা রকমের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমরা ভয়ের মধ্যেই রয়েছি। রাতে বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি না।’
অবস্থা সামাল দিতে ইতিমধ্যে গ্রামের ওই পাড়ায় তিন জায়গায় তিনটি স্ট্রিট লাইট বসানো হয়েছে ইন্দপুর থানার পক্ষ থেকে। বাসিন্দাদের সাহস জোগাতে প্রতি রাতে দু’জন করে পুলিশকর্মী মোতায়েন হয়েছে।
ইন্দপুরের বিডিও সুমন্ত ভৌমিক বলছিলেন, ‘প্রশাসন, পুলিশ ও বিজ্ঞান মঞ্চের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের বোঝানো হয়েছে। আমরা পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছি। কেউ গ্রাম ছেড়ে যাননি।’
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কমিটির সহ সম্পাদক জয়দেব চন্দ্রর মন্তব্য, ‘আমাদের একটি দল ওই গ্রামে গিয়ে বাসিন্দাদের বুঝিয়েছে। একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করা হয়েছে।
কিছু মানুষ অলীক গল্প বলে কুসংস্কার ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এই মুহূর্তে গ্রামবাসীর মন থেকে আতঙ্ক অনেকটাই কেটেছে। যাঁরা গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার কথা বলছিলেন, তাঁদের আটকানো গিয়েছে। আমরা আবারও ওই গ্রামে যাব। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমাদের ধারাবাহিক প্রচার চলবে।’