সুজিত রায়, আলিপুরদুয়ার
সমতল থেকে ২,৬০০ ফুট উঁচুতে আলিপুরদুয়ারের বক্সাদুয়ার ডাকঘর অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। ১২৫ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া এই ডাকঘর-ই এখন ঘরবাড়ি শ্রীজনা থাপার। তিনিই পোস্টমাস্টার, রানারও।
১৬ মাসের শিশুকন্যাকে মার কাছে রেখে প্রতিদিন সকালে পোস্ট অফিসে আসেন। টাকা বা চিঠি পৌঁছতে আবার বেরিয়ে পড়েন চুনাভাটি, আদমা, তাসিগাঁও গ্রামে। বক্সা সদরবাজার ছাড়া বাকি ১০টি গ্রাম অনেক দূরে। প্রত্যন্ত এলাকা।
পাহাড়ের গা-বেয়ে ওঠানামা করতে হয় শ্রীজনাকে। তাঁর বাবা যখন এই ডাকঘরে চাকরি করতেন, কষ্ট করেও সাধারণ মানুষের জন্য হাসিমুখে কাজ করতেন। এখন সেই কাজটা করেন শ্রীজনা। মহিলা হয়ে ভয় লাগে? তাঁর উত্তর, ‘ভয় পেলে চলবে? লড়াই না-করলে বাঁচার মানে কী? বাবার কাছেই লড়াই শিখেছি। তিনিই প্রেরণা।’
কালিম্পং গার্লস হাইস্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়ে প্রতিদিন পাঁচ কিলোমিটার বাড়ি থেকে হেঁটে যেতেন। আবার স্কুল ছুটি হলে পাহাড়ি পথ বেয়ে হেঁটে ফিরতেন।
পাশ করে কালিম্পং সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন শ্রীজনা। দ্বিতীয় বর্ষে থাকার সময়ে বাবার মৃত্যু তাঁকে নাড়িয়ে দেয়। কলেজের পাঠ শেষ না-করেই বাবার চাকরি নিয়ে চলে আসেন বক্সাদুয়ার ডাকঘরে। তাঁর একাকী পাহাড়ের কোলে নির্জন বক্সাদুয়ার ডাকঘর। স্বামী এসএসবি জওয়ান।
পোস্টিং সান্তালাবাড়িতে। তাঁদের দুই মেয়ে। এক মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আর এক জনের বয়স ১৬ মাস। দুধের শিশুকে মায়ের কাছে রেখে বক্সাদুয়ার ডাকঘরে আসতে হয় তাঁকে। অসুস্থ হলেও রেহাই নেই। লোক নেই যে! তার উপরে ডাকঘরে বিদ্যুৎ নেই।
আসলে কী জানেন, মেয়েরা সব পারে। ভারত-পাক যুদ্ধে দুই মহিলা কর্নেল যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন, তা গর্বের শ্রীজনা থাপা, ডাকঘর কর্মী নেই ইন্টারনেট। ৭০ জনের অ্যাকাউন্ট রয়েছে বক্সাদুয়ার ডাকঘরে।
কেউ টাকা তুলতে এলে বা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে চাইলে, সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে যেতে হয় রাজাভাতখাওয়া পোস্ট অফিস। ডাকঘর কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটি মোবাইল দিয়েছেন। কিন্তু, বক্সাদুয়ার ডাকঘরে বসে নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না। তাই কাজও ঠিক মতো হয় না।
তিন কিলোমিটার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সান্তালাবাড়ি। সেখান থেকে স্কুটিতে করে রাজাভাতখাওয়া পোস্ট অফিস। টাকা তুলে ফিরে গিয়ে গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দিতে হয়। গ্রাহক বাড়ি চলে গেলে ছুটতে হয় তাঁর বাড়িতে।
বছর ৩৫-এর শ্রীজনা একরাশ সাহস নিয়ে একাই পথ চলেন। তাঁর কথায়, ‘আসলে কী জানেন, মেয়েরা সব পারে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বায়ুসেনা ও সেনাবাহিনীর দুই মহিলা কর্নেল যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন, তা দেখে আমি খুব গর্ববোধ করি।’
স্থানীয় বাসিন্দা মন্টে ডুকপা, ইন্দ্রবাহাদুর থাপা বলেন, ‘বক্সা পাহাড়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বর্ষায় ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তবু নিজের কাজের প্রতি অবিচল শ্রীজনা।’