এই সময়, খড়্গপুর: বাবা স্বপ্ন দেখতেন, মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে বিয়ে দেওয়ার। আর মেয়ে স্বপ্ন দেখত উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ার। গ্র্যাজুয়েট হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দিনমজুর বাবার জীবনটাও পাল্টে দিতে চায় মেয়েটি।
দুই স্বপ্নের বিরোধ কিন্তু সহজে মেটেনি। কিন্তু শেষে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে বাবাকে পিছু হঠতে হয়। বিয়ে ভেঙে আনন্দে কলেজে ভর্তি হলো মেয়েটি। তবে পড়াশোনার খরচ কী ভাবে জোগাড় করবেন, তা ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না বাবা।
মেয়েটির পড়াশোনা করার ইচ্ছা দেখে পাশে দাঁড়ান কলেজের অধ্যক্ষ। পড়াশোনার সব খরচ তিনিই জোগাড় করে দেবেন বলে জানান।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরা ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব মুন্ডা পরিবারে জন্ম ওই ছাত্রীর। দাদা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভ্যান চালান। মেয়ে বড় হচ্ছে দেখে অনেকদিন ধরেই পাত্র খুঁজছিলেন বাবা। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পরেই মেয়েকে জানান, ‘আর পড়াশোনা নয়, এ বার বিয়ে করতে হবে।’
মেয়ে তো পড়ার জন্য নাছোড়। বাবার সাফ কথা, ‘কলেজে ভর্তি করানোর টাকা নেই। পড়ানোর খরচ দেব কী ভাবে?’ মেয়ে তখন গ্রামের এক ব্যক্তিকে বিষয়টি জানায়। তিনিই ফোন করেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের নারী, শিশু ও জনকল্যাণ স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ শান্তি টুডুকে।
শান্তি গ্রামে গিয়ে কিশোরীর বাবা-মাকে বোঝান, মেয়ের বয়স এখনও আঠারো হয়নি। আঠারো বছর না হলে বিয়ে দেওয়া যাবে না। শান্তি বলেন, ‘তখন ওর বাবা–মা জানিয়েছিলেন কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে বিয়ে বন্ধ করব।’
এরপর নাবালিকার বিয়ে দিলে কী শাস্তি হতে পারে, তা বোঝান শান্তি। মেয়েকে পড়ালে মিলবে সরকারি সুবিধাও, এও জানান শান্তি। অনেক বোঝানোর পরে পাত্রপক্ষকে না করে ওই ছাত্রীর পরিবার। এরপরেই কলেজের ডেবরা থানা শহিদ ক্ষুদিরাম মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রূপা দাশগুপ্তর সঙ্গে দেখা করেন ছাত্রী ও তার মা।
ছাত্রীর পারিবারিক অবস্থা শুনে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি ওই ছাত্রীর মাকে বুঝিয়েছি মেয়ের পড়ার জন্য একটি টাকাও তাঁদের খরচ করতে হবে না। আমরা বই দিয়ে সাহায্য করব। কন্যাশ্রীর পাশাপাশি বিবেকানন্দ স্কলারশিপের ব্যবস্থাও করে দেব। মেয়েটি অনলাইনে কলেজে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।’
তবে এই পরিবারের প্রথম কেউ কলেজে প্রথম পা রাখবে। এর আগে যা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কিশোরী বলে, ‘আমি চেষ্টা করব ভালো ফল করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। বাবা দিনমজুরি করে বহু কষ্টে পড়াচ্ছেন। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবার কষ্ট দূর করাই আমার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।’
মেয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাবা-মাও অবশ্য খুশি। বলছেন, ‘গরিব মানুষ তো। মেয়ের বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে চিন্তামুক্ত হতাম, এই ভেবেই বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। সবাই বোঝানোর পর মনে হচ্ছে, মেয়ে পড়াশোনা করে বড় হলে আরও ভালো হবে।’
শান্তি বলেন, ‘এ ভাবে যদি নাবালিকারা সচেতন হয়, তা হলে আর কাউকেই বাল্যবিবাহের শিকার হতে হবে না। নারী শিক্ষায় রাজ্য এগোলে পরিবর্তন ঘটবে সমাজেও। আমরা সেটাই চাই।’