প্রথম জন দেবাশিস হালদার। তিনি মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী তো বটেই, তা ছাড়াও কলেজ রাজনীতিতে মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বা এমসিডিএসএ-র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। অন্য জন, অনিকেত মাহাতো। তিনি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। যুক্ত ছিলেন এসইউসিআইয়ের ছাত্র সংগঠন ডিএসও-র সঙ্গে। এই দুই সংগঠন সোমবার মুখোমুখি হয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে। ফলাফল: এমসিডিএসএ- ১৭, ডিএসও- ০১। দু’টি আসন পেয়েছে দুই ‘নির্দল’ মুখ।
আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর সারা বাংলায় যে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল, সেই আন্দোলনের অন্যতম দুই মুখ ছিলেন দেবাশিস এবং অনিকেত। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরা যেমন আরজি করের নির্যাতিতার জন্য ‘বিচার’ চেয়ে পথে নেমেছিলেন, তেমনই তুলেছিলেন রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালগুলির উন্নতির দাবি। পাশাপাশি ছিল রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন। সেই সময় দেবাশিস, অনিকেত এবং আরও অনেক জুনিয়র ডাক্তার মিলে গড়ে তোলেন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস’ ফ্রন্ট’ (ডব্লিউবিজেডিএফ)।
সোমবার মেডিক্যাল কলেজে আয়োজিত হয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন। ভোটারের সংখ্যা ছিল এক হাজার। ভোট পড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ। এই নির্বাচনে বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তি অংশগ্রহণ করলেও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) কোনও প্রার্থী দেয়নি বা দিতে পারেনি। তারা এই নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে। যদিও মেডিক্যাল কলেজে তাদের কোনও সংগঠনও নেই। ২০২৪ সালের অগস্ট মাসে আরজি করের ধর্ষণ-খুন-কাণ্ডের মাস দুয়েক আগে কয়েক জন ছাত্র মিলে মেডিক্যাল কলেজে তৃণমূলের একটি ইউনিট খুলেছিলেন। তবে আরজি কর-কাণ্ডের পর সেই ইউনিট বিলুপ্ত হয়ে যায়। সদস্যেরাই ইউনিটে ‘তালা’ ঝুলিয়ে দেন। শুধু তৃণমূল নয়, মেডিক্যাল কলেজে অস্তিত্ব নেই সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়েরও।
লড়াই হল এমসিডিএসএ (দেবাশিসের পুরনো সংগঠন) এবং ডিএসও-র (অনিকেতের পুরনো সংগঠন) মধ্যে। এই লড়াইকে কী ভাবে দেখছেন আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম দুই মুখ? দেবাশিস বললেন, ‘‘আমাদের ডব্লিউবিজেডিএফ-এর লড়াই ছিল রাজনীতির ঊর্দ্ধে। সেই লড়াইয়ে আমরা একই আছি।’’ সোমবারের নির্বাচন নিয়ে দু’জনই একই সুরে জানান, কে জিতল, কে হারল, তা পরের বিষয়। এই নির্বাচন মেডিক্যাল কলেজের গণতন্ত্রের জয়। ‘থ্রেট কালচারের’ (হুমকি সংস্কৃতি) বিরুদ্ধে বড় জয়।
দেবাশিসের কথায়, ‘‘এমসিডিএসএ আমার প্রাক্তন সংগঠন। তবে সোমবার যে ভোট হল এবং তাতে যে ৮০ শতাংশ ভোট পড়ল, তা দেখে আমি খুশি। এটা সত্যিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দিয়েছে।’’ আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ তথা মেডিক্যালের এই প্রাক্তনীর কথায়, ‘‘৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী যে ভোট দিয়েছেন, তাতে আমি যেমন খুশি। তেমনই ব্যক্তিগত ভাবে লড়ে দু’জন জয় পেয়েছেন, তাতেও আমি গর্ববোধ করি।’’ তাঁর মতে, হুমকি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব মিলেছে এই ভোটে।
দেবাশিসের সুরে সুর মিলিয়েছেন অনিকেতও। তিনি বলেন, ‘‘থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয় এসেছে। এই ফলাফল থেকেই স্পষ্ট গণতান্ত্রিক পরিসরে তৃণমূলের কোনও জায়গা নেই। আমরা ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছিলাম। সেই লড়াইয়ে জয় পেয়েছি।’’ আরজি কর আন্দোলনের দুই সহযোদ্ধা একই সুরে বলেন, ‘‘আমাদের দু’জনের লড়াই ছিল একই। সেই লড়াইয়ে আমরা নিজেদের দলীয় পরিচয়কে বাদ রেখে একই হয়েছিলাম। আমাদের লড়াই ছিল নির্যাতিতার জন্য বিচার এবং মেডিক্যাল কলেজের থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে জয় পেয়েছি।’’
তবে শুধু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ নয়, রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজেরই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে তাঁরা এখনও অনড় বলে জানান দেবাশিস এবং অনিকেত। দু’জনের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন মার্চ মাসের মধ্যে সব কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে। কিন্তু জুনেও তা হল না। ডব্লিউবিজেডিএফ-এর অন্যতম দাবিই ছিল ছাত্র সংসদের নির্বাচন। সেই দাবি এখনও থাকবে।’’
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়াদের একাংশ। দীর্ঘ ১২ দিন ধরে অনশন চালান কয়েক জন পড়ুয়া। ১২ দিনের মাথায় অনশন প্রত্যাহার করার সময় আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা ঘোষণা করেন, নিজেদের ভোট তাঁরা নিজেরাই করবেন। কিন্তু নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। তখন সমাজের বিশিষ্টদের তত্ত্বাবধানে এই ভোট করানো হয়। সমাজকর্মী ও চিকিৎসক বিনায়ক সেন, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় এবং মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নজরদারি করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন পড়ুয়ারা। তাতে রাজি হন তাঁরা। শেষমেশ ওই নির্বাচনকে মান্যতা দেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তার পর থেকে সেই ধারায় বজায় রয়েছে মেডিক্যাল কলেজে। নকশালপন্থী সংগঠন এমসিডিএসএ-র দাবি, ২০২৩ সালে পড়ুয়াদের চাপে কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করেন। কিন্তু ২০২৪ সালে আরজি কর-কাণ্ডের জন্য ভোট হয়নি। তবে ২০২৫ সালে আবার ভোট হল মেডিক্যালে। জয় পেল এমসিডিএসএ।