• ‘আগন্তুক’-এ ‘অনিলা’র হাতে কী বই থাকবে সেটাও ঠিক করে দিয়েছিলেন বিজয়া রায়, জানালেন সন্দীপ
    আনন্দবাজার | ০২ জুন ২০২৫
  • সন্দীপ রায়

    মায়ের কথা উঠলে একটা কথাই বলতে পারি, মনে হয় না, উনি চলে গিয়েছেন। উনি সব সময়েই আছেন। আমাদের বাড়ি, বাবার প্রতিটি কাজে ছেয়ে আছেন। এখন ‘রায় সোসাইটি’র কাজ চলছে। ছবি থেকে চিঠি, চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধারের কাজ । মা-বাবার পুরনো ব্যবহৃত জিনিস আবার আগের মতো ঝকঝকে তকতকে করে তোলার চেষ্টা চলছে। পুরনো ছবি, চিঠি, বই, হাতের কাছে পাচ্ছি। সারা ক্ষণ মনে হচ্ছে, কোথাও তো যাননি ওঁরা। এই তো, আমাদের কাছেই আছেন! তার সঙ্গে জুড়ে আছে নানা কথা, গল্পও।

    বিজয়া রায়কে নিয়ে কি আর একটা গল্প? অনেক অনেক গল্প। বলতে বসলে ফুরোবে না। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? বাবার ছবিতে কোন দৃশ্যে কোন পোশাক কে কখন পরবে, তার সব দায়িত্ব মায়ের তো ছিলই। কিন্তু, তার সঙ্গে বাবার ছবির গানের ক্ষেত্রেও মায়ের ভূমিকা কিছু কম ছিল না। 'চারুলতা’ ছবিতে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি কিশোরকুমারকে তোলানোর দায়িত্বে পড়েছিল আমার মায়ের উপরেই। মা স্বরলিপি মেনে নিখুঁত গাইতেন। বাবার তাই গানের ক্ষেত্রে মায়ের উপর ছিল অগাধ ভরসা। এই গানটিও মা গেয়েছিলেন। মায়ের রেকর্ড করা গান মুম্বইয়ে কিশোরকুমারের কাছে যায়। শুনে শুনে সেই গান তুলেছিলেন কিশোরকুমার।

    গানের স্বরলিপির উপর মায়ের সাংঘাতিক দখল ছিল। বাবা এই কারণেই মায়ের উপর অত্যন্ত ভরসা করতেন। গানের লয় নিয়ে মা খুব সজাগ থাকতেন। পছন্দ না হলে শিল্পীকে ডেকে গান যাতে ঠিক লয়ে গাওয়া হয় সে কথা বলতেন, বিশেষ নজর দিতেন এ বিষয়ে। ‘আগন্তুক’ ছবিতে শ্রমণা চক্রবর্তীকে মা গান শিখিয়েছিলেন। ওই ছবি প্রসঙ্গেই মনে এল, একটি দৃশ্যে মমতাশঙ্কর অভিনীত চরিত্র ‘অনিলা’ একটা উইল প্রসঙ্গে স্বামীর সঙ্গে আলোচনার সময় ছবিতে কোন বইটা পড়বে? সেটা বাবা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। আমাদের খাবার টেবিলে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। খেতে খেতে বাবা সেই প্রসঙ্গ তুলতেই মা সেকেন্ডে সমাধান করে দিলেন। আমার এখনও মনে আছে, মা আগাথা ক্রিস্টির ‘পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস’ বইটা মমতাশঙ্করকে দিয়ে পড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনকি, বইটা বার করে পাতা খুলে দেখিয়েও দিয়েছিলেন, কোথায়, কোন জায়গায় সেটা পড়বে অনিলা। বাবা ছবিতে ওই বইটাই দেখিয়েছিলেন। একই ভাবে, ওই ছবিতে বিস্কুট বানাবে অনিলা। পুরোটাই আমার মায়ের বানিয়ে দেওয়া। মা তো বাড়িতে বানাতেন। সেই সরঞ্জাম নিয়ে সেটে এলেন। সেখানে তৈরি হল বিস্কুট। তার পরে এমন কাণ্ড হল, সবাই বিস্কুট খেয়ে নিল। শেষে বাড়ির জন্য আর কিছুই রইল না!

    ‘সোনার কেল্লা’য় ‘মুকুল’ ওরফে কুশল চক্রবর্তী যে লাল সোয়েটার পরেছিলেন সেটা মায়েরই হাতে বোনা। ‘চারুলতা’ ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায় যে রুমালটা তৈরি করছিলেন সেটাও আমার মায়ের হাতের কাজ! মা যেন বাবার প্রতিটি কাজে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। পোশাক পরিকল্পনার পাশাপাশি আউটডোর শুটিংয়ে সকলে যাতে আরাম করে কাজ করতে পারেন, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে কোথাও কোনও অসুবিধা না হয় সেই দিকটা দেখার দায়িত্বও মায়ের কাঁধে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতেন আমার বাবা।

    হাসিমুখে সব দায়িত্ব সামলেছেন মা। আজ আরও বেশি করে অনুভব করতে পারি, বিজয়া রায়-সত্যজিৎ রায় একে অন্যের পরিপূরক। সত্যজিতের যে কোনও নির্মাণের অন্তরালে ছায়া হয়ে থেকেছিলেন বিজয়া রায়। আমার মা।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)