রোহিঙ্গাদের অবৈধ প্রবেশ এবং কুকাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে রাজনৈতিক বিতর্ক নতুন নয়। রাজ্য প্রশাসনের উদ্দেশে দেশের বিমানবাহিনীর তরফে গোয়েন্দা তথ্য ভরপুর এক পত্রবার্তায় তা আরও ইন্ধন পেল। ‘অরক্ষিত’ সীমান্তের সুযোগ নিয়ে এ দেশে রোহিঙ্গাদের অবৈধ প্রবেশ বৃদ্ধি নিয়েও যা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে।
অসাধু উপায়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের একাংশের এ দেশের ভোটার এবং আধার কার্ড জোগাড় করার ঘটনায় একযোগে নড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, আঞ্চলিক বিদেশি নিবন্ধীকরণ দফতর (এফআরআরও) এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশন। বিমানবাহিনীর সতর্কবার্তা, এ বার রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়েও উদ্বেগ মেলে ধরল। উত্তরবঙ্গের শেষ সফরে সীমান্ত এলাকাগুলিতে নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশও অর্থবহ বলে মত বিশ্লেষকদের অনেকেরই।
গত ৬ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হয়েছিল। ৭ মে রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশকে সংশ্লিষ্ট চিঠিটি পাঠান বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ। তবে চিঠিতে রোহিঙ্গাদের তৎপরতার প্রসঙ্গ শুধু ওই তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির বিষয় নয় বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞ কর্তাদের অনেকে। চিঠিতে রাজ্যকে বিমানবাহিনী জানায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের সুরক্ষার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ হাসিমারা বিমানঘাঁটির আশপাশেই রোহিঙ্গাদের একাংশ উদ্বেগজনক ভাবে জড়ো হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকার হাসিমারা বিমানঘাঁটিটি ভুটান সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার, নেপালের থেকে ১৪০ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। চিকেনস নেক এলাকার কাছে নিউ জলপাইগুড়ি থেকেও হাসিমারার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এই পরিস্থিতিতে ওই তল্লাটে নিয়মিত পুলিশি টহল এবং গ্রামগুলিতে সন্দেহভাজন কারও আনাগোনা নিয়ে সচেতনতা প্রচারে জোর দিয়েছে বিমানবাহিনী। তাদের আর্জি, তেমন কোনও গতিবিধি নজরে এলে হাসিমারা বিমানঘাঁটি কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সাইবার সুরক্ষা নিয়েও সজাগ থাকতে বলেছে কেন্দ্র।
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সেই সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২১৭ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরে বেশির ভাগ এলাকা অরক্ষিত ছিল। কাঁটাতার বসানোর জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা চলে রাজ্যের। কেন্দ্রের অভিযোগ ছিল জমি না পাওয়ার। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলের পরে রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক বৈঠকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছাড়পত্র পেতে শুরু করেছে। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা প্রশাসন সূত্রের দাবি, কেন্দ্র যে টাকা দেয়, তা দিয়ে বেসরকারি জমি কিনে বিএসএফ-কে হস্তান্তরের কাজ ইতিবাচক গতিতেই চলছে। কিন্তু শতাধিক একর জমি হস্তান্তর নিয়ে জট থাকতে পারে, অনুমান সংশ্লিষ্টদের।
প্রশাসনের শীর্ষমহলের কেউ এ নিয়ে সরকারি ভাবে মুখ খুলতে চাননি। তবে রাজ্য প্রশাসনের একাংশের দাবি, পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগে শুরু হয়েছে বাড়তি নজরদারির তৎপরতা। উত্তরকন্যার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীও বলেছিলেন, “বাইরে থেকে ঢুকে কোনও জঙ্গি যেন আশ্রয় নিতে না পারে।” পরে আইজি (উত্তরবঙ্গ) রাজেশ যাদবও জানিয়েছিলেন, প্রতিটি সীমান্ত পথে আচমকা নাকাতল্লাশি শুরু হয়েছে। গ্রামে গ্রামে যোগাযোগও বাড়ানো হয়েছে।
অভিজ্ঞ আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, পহেলগাম-কাণ্ডের পরে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা নিয়ে আরও সতর্কতা জরুরি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে সে দেশের পরিস্থিতিও ভিন্ন। সংঘাতের আবহে পাকিস্তানের বিভিন্ন মহলের ভারত-বিরোধী অবস্থানও নিরাপত্তা-আধিকারিকদের ভাবাচ্ছে। ফলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কেন্দ্রের একাধিক সংস্থা একযোগে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট মহল আরও জানাচ্ছে, মুর্শিদাবাদে ধৃত জঙ্গি শাব শেখের নাম একাধিক জায়গায় ভোটার তালিকায় পাওয়া গিয়েছিল। তার পরে আরও অনেক বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে অবৈধ ভাবে এ দেশে ভোটার এবং আধার কার্ড মিলেছে। এমনকি, মুর্শিদাবাদে সাম্প্রতিক অশান্তির নেপথ্যে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের হাত ছিল বলেও রাজনৈতিক স্তরে চর্চা হয়। এই আবহে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি নিয়ে বার্তাটিও তাৎপর্যপূর্ণ বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।