• প্রাক্তনরা নিয়ে যান বাসব-ডেরায়
    আনন্দবাজার | ০২ জুন ২০২৫
  • বাসবরাজু পর্যন্ত পৌঁছনোর পথ কি তবে তাঁর প্রাক্তন সঙ্গীরাই তৈরি করে দিয়েছিলেন?

    সঞ্জু মাণ্ডবী ও সন্নু কোটাম ঘরোয়া আড্ডায় বসে যা বলছিলেন, তার থেকে এমনই ইঙ্গিত সামনে চলে আসে।

    অবুঝমাঢ়ে যখন পৌঁছলাম, আকাশের মুখ ভার। অবুঝমাঢ়ের মনের মধ্যেও এমন মেঘ জমে আছে কি না, নারায়ণপুর পুলিশের দেওয়া গার্ড রেলের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। কারণ, সেই মনের সামান্য আঁচ না পেলে ‘লাল-গড়’ কোহকামেটা, কচ্চাপালের মতো গ্রামগুলির দিকে এগোনো যাবে না। ঢোকা যাবে না, দূর থেকে দেখতে পাওয়া জঙ্গলেও।

    সঞ্জু, সন্নুরা বলছিলেন, এমনই কোনও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা পথ ধরেই ‘হয়তো’ এগিয়েছিল বাহিনী। কথায় কথায় তাঁরা ‘হয়তো’ রেখে যাচ্ছিলেন। কারণ, বাসবরাজুকে খুঁজতে যাওয়ার পথ সরাসরি বাতলে দিতে নারাজ ওঁরা, এখনও। সেই দলটিতে ছত্তীসগঢ় পুলিশের ‘ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ড’ (ডিআরজি) ও বস্তার ফাইটার্স-এর সদস্যরা ছিলেন। সঞ্জু ও সন্নু ডিআরজি-র সদস্য।

    বাসবরাজুর সংঘর্ষ নিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি সঞ্জু। তবে জানিয়েছেন, “আমরা এলাকা ঘিরে ফেলেছিলাম, গোল করে। শতাধিক ডিআরজি ও বস্তার ফাইটার্সও অভিযানে ছিল।”

    অর্থাৎ, প্রাক্তন মাওবাদীদেরই একাংশকে নিয়ে বাসবরাজুকে খুঁজতে বার হয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যাকে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’ বলেই ব্যাখ্যাকরা হচ্ছে।

    এই প্রাক্তন ‘কাঁটা’রা কেন যোগ দিয়েছিলেন মাওবাদীদের দলে? কেনই বা সেখান থেকে ফিরে এলেন সাধারণের জীবনে? বস্তুত, এর জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মাওবাদীদের উত্থান ও কার্যতপতনের রহস্য।

    সঞ্জু বলছিলেন তাঁর বাড়ির কথা। বিজাপুর জেলায় পালাগুড়া গ্রামে থাকতেন তিনি। পমেড় থানা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মাওবাদী সংগঠনে যোগ দেন। সেটা ২০১১ সাল। দীর্ঘদিন অ্যাকশন স্কোয়াডে ছিলেন।

    ২০২০ সালে সুকমার মিনপা অঞ্চলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুরুতর জখম হন। গুলি লাগে পিঠে ও বাঁ উরুতে। সঞ্জুর কথায়, “তখন বুঝেছিলাম, চিকিৎসা না হলে মরেই যাব। শহরে যাওয়ার সাহস ছিল না। বুঝে গিয়েছিলাম, এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জেতা সম্ভব নয়।”

    ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেন সঞ্জু। ডিআরজি-তে শুরুতে ছিলেন গোপনীয় তথ্যদাতা। পরে ‘কাজের ভিত্তিতে’ পদোন্নতি হয়ে কনস্টেবল পদে নিযুক্ত হন।

    সন্নু কোটামও বিজাপুরের। তবে গঙ্গালুর থানার কোরচৌলি গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি। ২০১৫ সালে দন্তেওয়াড়া লোকাল গেরিলা স্কোয়াডে যোগ দেন। নিজেই বলছেন, “প্রথমে ভাবতাম, নির্দিষ্ট কোনও আদর্শের জন্য লড়াই করছি। পরে বুঝি, আমাদের শীর্ষ নেতারা আমাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন।” ২০২০ সালে অস্ত্র-সহ আত্মসমর্পণ করেন সন্নু। পরে তাঁর জায়গা হয় ডিআরজি-তে। ভাল কাজের ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়ে এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর।

    এমনই সব বাছাই করা প্রাক্তন মাওবাদী ছিলেন বাসবরাজু্র বিরুদ্ধে অভিযানে।

    সন্নু বলছিলেন, “আমরা এই এলাকাটা ভাল করে চিনি। ফলে ঘেরাওয়ের সময়, কোন পথ ব্যবহার করা যেতে পারে বা কোথায় সম্ভাব্য ঘাঁটি রয়েছে, তা আগে থেকে নিখুঁত আন্দাজ করেছিলাম।”

    ব্যস, ওই পর্যন্তই। সঞ্জুর মতো তিনিও এর বেশি কিছু বলতে চাননি সংঘর্ষ নিয়ে। এই দুই প্রাক্তন মাওবাদী যে সে দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট ডিআরজি-র দন্তেওয়াড়া ইনচার্জ ইনস্পেক্টর প্রদীপকুমার বিসেনের কথায়। তিনি বলেন, “সঞ্জু, সন্নুর মতো ডিআরজির কমান্ডোরা আগে জঙ্গলে ছিলেন। তাই অপারেশনের সময় ওঁরা অনেক কিছু আগাম বুঝতে পারেন। এই সুবিধাটাই কাজে লেগেছে।”

    প্রাক্তন মাওবাদীদের মধ্যে আরও এক জন আছেন, যাঁর এখন আফসোসের অন্ত নেই। তিনি সুন্দরী কোররাম।

    সুন্দরী বলছিলেন, তাঁকে নারায়ণপুর জেলার ওরছা থানার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে যায় মাওবাদীরা। সালটা ২০০২। তাঁর বয়স তখন মোটে ১৫। প্রথমে রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হলেও পরে, তাঁকে যুক্ত করা হয় দন্তেওয়াড়ার মহিলা দলম স্কোয়াডে। সুন্দরী বলেন, “আমরা চাইতাম ফিরতে, কিন্তু পারিনি। বলত, পালালে মেরেফেলা হবে।”

    ২০০৮ সালে তাঁকে আনা হয় মাওবাদীদের নারায়ণপুর-ধৌরাই এলাকার লোকাল গেরিলা স্কোয়াডে। ২০১০ সালে ধৌরাইয়ের জঙ্গলে বড়সড় হামলায় প্রাণ হারান ২৬ জন সিআরপি জওয়ান। সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন সুন্দরী। তিনি জানাচ্ছেন, “সেই সময় মনে হত, আমাদের বাঁচার কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, আমাদের আদর্শের নামে ভুল পথে চালিত করা হয়েছিল।”

    ২০১৪ সালে স্বামী গোপী ইস্তমের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেন সুন্দরী। তার পর ডিআরজি-তে ফিল্ড কমান্ডো ইউনিটে যোগ দেন। এখন ডিআরসি-র কনস্টেবল। বাসবরাজুর দলের সঙ্গে সংঘর্ষের দিন তাঁকে অন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আফসোস করছিলেন সুন্দরী, ‘‘সে দিন আমার একটি বিশেষ দায়িত্ব ছিল অন্য এলাকায়, তাই ওখানে যেতে পারিনি। খুব আফসোস হচ্ছে!”

    কেন এই মন-বদল? সুন্দরী বলছিলেন, ‘‘আগে ওরা অস্ত্র দিয়ে বলত, শত্রুকে মারো। এখনও আমাদের হাতে অস্ত্র আছে। কিন্তু সে অস্ত্র সাধারণ মানুষকে রক্ষাকরার জন্য।’’

    বস্তার রেঞ্জের আইজি সুন্দররাজ পট্টিলিঙ্গম বলছেন, “সরকারি নীতির মাধ্যমে আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসনের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক প্রাক্তন মাওবাদী এখন বাহিনীরসক্রিয় সদস্য।”

    তবে বিশ্লেষক মহলের একাংশের মতে, এই ‘মডেল’ বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিছুটা কাজ করলেও, সব ক্ষেত্রে কতটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনবে বা স্থানীয় স্তরে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে— সেটা সময়ই বলবে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)