এই সময়, বর্ধমান: বয়স ছুঁয়েছে ৮৫-র কোঠা। আর সঙ্গ দেয় না শরীর। প্রিয়জনদের হারিয়ে কোনও কিছুই যেন ভালো লাগে না। তবুও এই দিনটা এলে মন খারাপ করে রায়নার সেহারা পঞ্চায়েতে বেঁন্দুয়া গ্রামের বৈষ্ণবপাড়ার বাসিন্দা প্রমীলা সাহার। চোখে জল আসে। দুই জামাইকে ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করতে মন চাইলেও মুখ ফুটে বলতে পারেন না। তবে বড় নাতির উদ্যোগে বহুদিনের ইচ্ছে অবশেষে পূরণ হলো তাঁর। নিজের বাড়িতেই দুই জামাইয়ের কপালে ফোঁটা দিলেন। বাড়িতে বসল বহু প্রতীক্ষার মিলনমেলার আসর।
দিন দুয়েক আগের কথা। দুই মেয়ে আরতি আর মিনতির বিয়ের পরে জামাইষষ্ঠীর দিন বাড়িতে কী কী হতো তা নিয়ে বড় নাতির কাছে গল্প করছিলেন প্রমীলা। সংসারের অভাব ঠেলেও তাঁর স্বামী কী ভাবে সারাবছর ধরে এই দিনের জন্য পয়সা জমিয়ে রাখতেন, সেই কথা বলছিলেন। বড় নাতি কৃষ্ণ সাহা সবটা শুনে দুই পিসেমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বারের জামাইষষ্ঠীতে তাঁদের আসার জন্য আবদার করেন।
প্রথমে আসতে রাজি না–হলেও বৃদ্ধ শাশুড়ির কথা ভেবে অসুস্থ শরীরে ফোঁটা নেওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়িতে আসেন বড় জামাই রণজিৎ সাহা ও ছোট জামাই তাপস সাহা। রবিবার সকালে দুই জামাইয়ের কপালে যখন ফোঁটা দিলেন, তখন প্রমীলার চোখে খুশির জল। তাঁর মনের কথা বুঝতে পারায় বড় নাতি কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে করলেন আদরও।
কোনও ত্রুটি রাখেনি কৃষ্ণও। সকালের জলখাবারে লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল। দুপুরের মেনুতে ভাজাভুজির মধ্যে ছিল শাক, বেগুন, পটল ও আলু ভাজা। েমন কোর্সে ঝিঙে পোস্ত আর পাঁঠার মাংস। শেষপাতে চাটনি, পাঁপড়, দই, দু’রকমের মিষ্টি, সঙ্গে আম। ছিল সফ্ট ড্রিঙ্কও। বিকেলে চায়ের সঙ্গে ছিল চিকেন পকোড়া। আর রাতের মেনুতে লুচি, মুরগির মাংসের কষা আর মিষ্টি। এ সব রান্না হয়েছে বাড়িতেই।
দিন শেষে বৃদ্ধা বলেন, ‘এ দিন শাশুড়ির ফোঁটা নিলে জামাইয়ের মঙ্গল হয়। আমরা পুরোনো দিনের মানুষ, এ বিশ্বাসেই বেঁচে রয়েছি। তবে এর পরে হয়তো আর পারব না। শরীর দেবে না।’ বড় জামাই রণজিৎ সাহা বলেন, ‘আমার এই ৬৫ বছর বয়সে এসেও শাশুড়ির ফোঁটা নিতে পারছি, এই ভাগ্য কতজনের রয়েছে। অসুস্থতা উপেক্ষা করেও যে ভাবে আমাদের বরণ করেছেন, আর্শীবাদ দিয়েছেন, তা মা ছাড়া আর কে পারবে।’ বছর ৫৫–র ছোট জামাই তাপস সাহার কথায়, ‘ভালো লাগল, পুরোনো দিনের অনেক কথাই মনে পড়ল।’
২০১৬ সালে বড় বৌমা চাঁপা সাহা, ২০২২ সালে স্বামী তারাপদ ও তার দু’বছর পরে বড় ছেলে তপনকে হারানোর পরে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন ওই বৃদ্ধা। এতদিনে তাঁর মুখে হাসি ফুটল বলে জানান কৃষ্ণ। তিনি বলেন, ‘মা-বাবা, দাদু সবাই একে একে চলে গিয়েছে। এখন তো ঠাকুমাই আমাদের আশ্রয়স্থল। তাঁকে আনন্দ দিতে পারার মধ্যে দিয়ে আমরা যে কতটা আনন্দ পেয়েছি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আজ বহুদিন পরে দুই পিসি, এক দিদি ও দুই পিসেমশাই, জামাইবাবু, ভাগনেদের নিয়ে বাড়িতে যে মিলনমেলা বসেছিল তা শুধুমাত্র ঠাকুমার জন্য।’