• মোদীর পাঁচ ‘তিরে’র পাশাপাশি বঙ্গ বিজেপিকে শাহ আরও দুই ‘হাতিয়ার’ চেনালেন, জামানত রক্ষার চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন দিদিকে
    আনন্দবাজার | ০২ জুন ২০২৫
  • তিন দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ‘পাঁচ সঙ্কটে’র কথা বলে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারকে বিঁধেছিলেন, তার মধ্যে ছিল ‘হিংসা’, ‘দুর্নীতি’, ‘মহিলাদের উপর অত্যাচার’, ‘বেকারত্ব’ এবং গরিবের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার রাজনীতি’। রবিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখেও শোনা গেল ‘হিংসা’, ‘দুর্নীতি’ আর ‘মহিলাদের উপর অত্যাচারে’র প্রসঙ্গ। তার সঙ্গে অন্য দুই ‘হাতিয়ার’ বঙ্গের বিজেপি কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন শাহ। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত সাংগঠনিক নেতৃত্বের সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে শাহ বার বার তুললেন ‘অনুপ্রবেশ’ এবং ‘হিন্দুদের উপর অত্যাচারে’র অভিযোগও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে শাহ বললেন, ‘‘সাহস থাকলে হিংসা, রিগিং না-করে ভোটে লড়ে দেখান, আপনার নিজের জামানতটুকুও জব্দ হয়ে যাবে।’’

    কলকাতায় রবিবার শাহের তিনটি কর্মসূচি ছিল। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল সরকারি অনুষ্ঠান, আর তৃতীয়টি ধর্মীয়। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল নেতাজি ইন্ডোরেই। সেই মঞ্চ থেকে শাহ যা বললেন, অনেকের মতে তা কর্মী সম্মেলনের ভাষণ নয়, বরং বিধানসভা ভোটের জনসভার বক্তৃতা। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে কোন কোন ‘অস্ত্রে’ ঘায়েল করার চেষ্টা করতে হবে, নিজের ভাষণে শাহ তার রূপরেখা নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। শাহের কথায়, ‘‘মমতাদিদি এই মহান বঙ্গভূমিকে অনুপ্রবেশ, দুর্নীতি, মহিলাদের উপর অত্যাচার, অপরাধ, বোমাবাজি এবং হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কেন্দ্র বানিয়ে দিয়েছেন।’’ দুর্নীতি, মহিলাদের উপরে অত্যাচার এবং হিংসা প্রসঙ্গে মোদী বৃহস্পতিবার যা বলে গিয়েছিলেন, রবিবার ওই সব প্রসঙ্গে শাহের বক্তব্যের সারকথাও প্রায় একই। তবে অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে শাহ রবিবার অনেক বেশি সরব হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘এখানে নির্বাচন শুধু বাংলা জেতার লড়াই নয়, ভারতের সুরক্ষার লড়াই। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সীমান্ত বাংলাদেশিদের জন্য খুলে দিয়েছেন। তাঁর আশীর্বাদেই অনুপ্রবেশ হচ্ছে।’’ সংসদে তৃণমূল একাধিক বার অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে শাহকে তথা তাঁর মন্ত্রককে দায়ী করেছে। সে কথা টেনে এনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রবিবার বলেন, ‘‘তৃণমূলের সাংসদ আমাকে সংসদে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিএসএফ কী করছে? দিদি, আমরা আপনার কাছে জমি চেয়েছিলাম। আপনি জমি দিন, তারপর দেখবেন একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না। আপনি ভেবেচিন্তেই সীমান্তে জমি দিতে চান না। কারণ অনুপ্রবেশ হলেই আপনার ভোটব্যাঙ্ক বাড়বে। তাতে আপনার পরে আপনার ভাইপো মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবে।’’

    ‘হিন্দুদের উপর অত্যাচার’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শাহ রবিবার মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘মুর্শিদাবাদে কদিন আগে হিংসা হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বারবার বলেছিল বিএসএফ আনার জন্য। কিন্তু এখানে সরকার বিএসএফ চায়নি। কারণ বিএসএফ এলে হিন্দুরা রক্ষা পেত।’’ বিজেপি হাই কোর্টে মামলা করার পরে হাই কোর্ট বিএসএফ মোতায়েনের নির্দেশ দেয় বলে শাহ মনে করিয়ে দেন। শাহের কথায়, ‘‘তৃণমূলের নেতা মুর্শিদাবাদে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের উপরে অত্যাচার ঘটিয়েছেন। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, যে ভাবে বাংলার সরকারের মন্ত্রী এই দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন, তাতে একে রাজ্য স্পন্সরড দাঙ্গা বলা যায়।’’ ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলন, ইমাম ভাতা, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ’, দুর্গাপুজোয় বিসর্জন পিছিয়ে দেওয়া, কার্তিক পুজো এবং সরস্বতী পুজোয় অশান্তি, একটি বিশেষ চলচ্চিত্র পশ্চিমবঙ্গে দেখাতে না দেওয়া-সহ একগুচ্ছ অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রবিবার তোপ দেগেছেন শাহ। তিন দিন আগে মোদীর ভাষণের সুর এত চড়া ছিল না। তাতে সরাসরি মমতার নাম করে এমন মুহুর্মুহু আক্রমণও ছিল না। বিজেপি কর্মীদের উদ্দেশে শাহের মন্তব্য, ‘‘আজ সংকল্প করুন, ২০২৬ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারকে মূল সমেত উপড়ে ফেলে দেবেন। এই মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকালে আরজি করের মত ঘটনা ঘটে, বছরের পর বছর সন্দেশখালিতে মা-বোনদের উপর অত্যাচার হয়। আর দিদি আপনি শুধু ভোটব্যাঙ্কের হিসেব করছেন!’’

    হিন্দু শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’র তত্ত্বও রবিবার উঠে এসেছে শাহের ভাষণে। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে কয়েকদিন আগে মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এসেছিলেন। তিনি জানালেন, হিন্দুদের নাম কেটে দেওয়া হচ্ছে ভোটার তালিকা থেকে। আমি তাঁকে বললাম, ভয় পাবেন না। যাঁদের নাম কাটার নোটিস এসেছে, তাঁরা সিএএ-তে আবেদন করুন, আমি তাঁদের নাগরিকত্ব দেব।’’ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে শাহ বলেন, ‘‘মমতার নোটিসে কারও ভয় পাওয়ার দরকার নেই। মোদীজি এই আইন শরণার্থী ভাইবোনদের অধিকার দেওয়ার জন্যই এনেছেন।’’ তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘‘পহেলগাঁওয়ে মৃত ভাইয়ের (বিতান অধিকারী) স্ত্রীকে আমরা মাত্র দু’দিনে নাগরিকত্ব দিয়েছি।’’

    হিংসা প্রসঙ্গে শাহ বলেন, ‘‘পুরো দেশে এখন নির্বাচনী হিংসা বন্ধ হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র যেখানে নির্বাচনের সময় এবং দিদির জেতার পর শয়ে শয়ে বিজেপি কর্মীদের খুন করা হয়েছে।’’ এর পরেই তিনি সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘‘দিদি কতদিন বাঁচাবেন অপরাধীদের? আমার কথা শুনুন, আপনার সময় শেষ হয়ে এসেছে। ২০২৬ এ ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার হবে। আর আমাদের কর্মীদের যারা খুন করেছে, তাদের মাটির তলা থেকে খুঁজে বের করেও শাস্তি দেব।’’

    ‘অপারেশন সিঁদুর’ প্রসঙ্গেও মমতাকে রবিবার আক্রমণ করেছেন শাহ। বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের ১০০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে সন্ত্রাসবাদীদের সদর দফতর গুঁড়িয়ে দিয়েছি। তাদের মৃত্যু উপহার দিয়েছি। আর এই দেখে দিদির কষ্ট হচ্ছে। যখন পাহেলগাঁওয়ে বাংলার মানুষ মারা যায়, তখন যদি আপনি এই কষ্ট, সহানুভূতি দেখাতেন তা হলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু তখন আপনি কিছু বলেননি। যখন মোদীজি অপারেশন সিঁদুর করে এখানে এলেন, তখন আপনি একটি নিন্দনীয় রাজনৈতিক বয়ান দিয়ে অপারেশন সিঁদুরের বিরোধিতা করলেন।’’ সরাসরি মমতার উদ্দেশে শাহের বয়ান, ‘‘আজ আমি দিদিকে বলতে এসেছি, আপনি এই অপারশনের বিরোধিতা করেননি, আপনি এই দেশের মা-বোনের আবেগের সঙ্গে ছেলেখেলা করেছেন।’’ শাহের কথায়, ‘‘আমি পশ্চিমবঙ্গের মাতৃশক্তিকে আবেদন জানাই, আগামী নির্বাচনে অপারেশন সিঁদুরের উপর প্রশ্ন তোলা মমতা বন্দোপাধ্যায়কে আপনারা বুঝিয়ে দেবেন, সিঁদুর নিয়ে প্রশ্ন করলে কী হয়।’’

    দুর্নীতি প্রসঙ্গেও রাজ্য সরকার তথা তৃণমূলের বিরুদ্ধে শাহ তোপ দেগেছেন। তাঁর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ইউপিএ জমানার ১০ বছরে কেন্দ্রের কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছিল ২ লক্ষ ৯ হাজার কোটি টাকা। আর মোদী সরকাররে ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রের কাছ থেকে পেয়েছে, ৮ লক্ষ ২৭ হাজার কোটি টাকা। শাহের সভা শেষ হওয়ার পরেই বিজেপির তরফ থেকে সেই ‘হিসেব’ বিশদে প্রকাশও করা হয়। শাহ বলেন, ‘‘বাংলার মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা তৃণমূলের সিন্ডিকেটে গেছে। আমি বাংলার মানুষকে জিজ্ঞেস করতে চাই, এই টাকা সিন্ডিকেটের নাকি বাংলার মানুষের? মোদী যে টাকা পাঠান, সেই টাকা সিন্ডিকেটের ভোগে চলে যায়। এই টাকা বাংলার মা, বোন, যুব সমাজ, গরিবদের টাকা।’’ শাহের কটাক্ষ, ‘‘কলকাতার রাস্তায় যোগ্যদের চাকরি বিক্রি হয়। আর এদের বাড়ি থেকে এত টাকা পাওয়া যায় যে গুনতে গুনতে যন্ত্রও খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু টাকা শেষ হয় না।’’

    শাহের আগে রবিবার নেতাজি ইন্ডোরে ভাষণ দেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সুকান্ত নিজের ভাষণে বিজেপি কর্মীদের বলেন ‘পাল্টা মারে’র পন্থা নিতে। সুকান্তের কথায়, ‘‘যদি আপনাদের কেউ মারতে আসে, পাল্টা মারুন। মার খাবেন না। মার দিয়ে তবে নেতৃত্বকে জানাবেন।’’ শুভেন্দু তাঁর ভাষণে তিনটি বিষয়ে শাহকে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানান— বিতানের স্ত্রীকে নাগরিকত্ব দেওয়া, বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম কুমারকে পাকিস্তানের কব্জা থেকে ছাড়িয়ে আনা, উত্তরবঙ্গের কৃষক উকিল বর্মণকে বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে আনা।

    নেতাজি ইন্ডোরে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের ‘ভোটজয়ের অঙ্ক’ও বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন শাহ। তিনি বলেছেন, ‘‘২০২৪ সালে ৯৭টি আসনে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। আর ১৪৩ আসনে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট আমরা পেয়েছি কর্মীদের পরিশ্রমের কারণে।’’ শাহের কথায়, ‘‘আর একটু কাজ বাকি রয়েছে আমাদের। আর ৪-৫ শতাংশ ভোট পাওয়া বাকি আছে আমাদের। আগামী নির্বাচনে আমরা এখানে সরকার তৈরি করব।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)